প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ইস্যুতে অন্যান্য দেশের পাশাপাশি ভারত, রাশিয়া ও চীনের সমর্থনও বাংলাদেশ পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে যেতে এই দেশগুলোও বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে ।

বুধবার বিকালে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী এই কথা বলেন। সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া সফর উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে থাকে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা ও চুক্তি হলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুরু থেকেই বাংলাদেশের বন্ধু রাশিয়া ও চীনের তেমন সাড়া মিলেনি। প্রতিবেশী দেশ ভারতও ছিল অনেকটা নীরব। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের মনোভাব কী এবং এই তিনটি দেশের অবস্থান কী পর্যায়ে এমনটা জানতে চান সাংবাদিক।

উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটাই সবচেয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলের সভাপতিসহ সদস্যরা বাংলাদেশে এসেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প দেখেছেন। এরপর আমার সাথে তাদের বৈঠক হয়েছে। তাদের মনোভাব অত্যন্ত ইতিবাচক। তারাও চান, মিয়ানমার থেকে যে ১১ লাখের মতো মানুষ বাংলাদশে এসেছে তারা তাদের নিজের দেশে ফিরে যাক। এবং তারা যেন অধিকার নিয়ে ভালোভাবে বসবাস করতে পারে, সে জন্য তারা যথেষ্ট আন্তরিক। যে জন্য আমাদের সাথে কথা বলার পর মিয়ানমার গেছেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘সিকিউরিটি কাউন্সিলের যে সদস্যরা এসেছে, তাদের সবার প্রতিনিধিরাই কিন্তু এসেছে। তাদের সাথে আমি আলাদা আলাদা কথা বলেছি, তারাও সহানুভূতিশীল। এরাও চায় তারা ফিরে যাক। তারা ঘরবাড়ি তৈরি করে দিতেও রাজি। চীন বলেছে, ভারত বলেছে, জাপান বলেছে, তার্কি বলেছে, রাশিয়াও প্রস্তুত। মিয়ানমার এদেরকে ফিরিয়ে দিলে তাদের থাকার জন্য যা যা দরকার, এটা কিন্তু করে দেবে। অন্তত আমাদের কূটনৈতিক সাফল্য এটাই।’

‘আমরা ১৬ কোটি মানুষের দেশ এবং ছোট্ট একটা ভূখণ্ড। তারপরও এতগুলো মানুষকে যে আমরা আশ্রয় দিয়েছি, তাদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সবধরনের ব্যবস্থা করেছি, সেটার জন্য তারা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কারণ, এত অল্প সময়ে এত লোকের ব্যবস্থা, পৃথিবীর অনেক দেশই পারে না। কিন্তু বাংলাদেশ তা পেরেছে। সেই ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে যথেষ্ট সমর্থন জানিয়েছে, সাধুবাদ জানিয়েছে, সেই সঙ্গে সঙ্গে তারা মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ দেবে যেন তারা তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু সামনে বর্ষাকাল। আমাদের দেশে বন্যা, ঝড়, বৃষ্টি, কালবৈশাখী হচ্ছে। এই যে মানুষগুলো বসবাস করছে ক্যাম্পে, এটা অত্যন্ত কষ্টকর। আমাদের প্রায়ই ল্যান্ড স্লাইড (ভূমিধস) হয়, এটাও তো সমস্যা, আমাদের নরম মাটি। এজন্য তাদের জন্য ভাসানচরে বসতির ব্যবস্থা করছি। আগামী বর্ষার আড়েই যারা পাহাড়ে বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যারা বাস করছে, তাদেরকে সেখানে সরিয়ে নিতে পারব। ঘরবাড়ির ডিজাইন তাদের দেখালাম, তারা আমাদেরকে যথেষ্ট সাধুবাদ জানিয়েয়েছে। সমগ্র বিশ্বের যে সমর্থন পেয়েছি, এটাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দুর্গত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি।’

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘আমরা নিজেদের কথাও চিন্তা করি। ১৯৭১ সালে আমাদেরকেও এভাবে ভারতের মাটিকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ৭৫ এর পরেও আমাদেরকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আমাদের সে অভিজ্ঞতা আছে, এইভাবে একটা দেশে ঘরবাড়ি হারা হয়ে থাকা, এর চেয়ে দুর্ভোগ, এর চেয়ে কষ্টের কিছু হতে পারে না। আমি ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশের মানুষকে, স্থানীয় জনগণকে। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তারা তাদেরকে দেখছে।’

‘স্থানীয় যারা আছে, তাদের সমস্যা যেন না হয়, সেদিকেও আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে রোহিঙ্গারা অনেক দিন তাকবে। অর্থনৈতিক ইমপ্যাক্ট কী? ১৬ কোটি মানুষকে আমরা খাদ্য দেই, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। যখন রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করল, আমরা দেখলাম, সেই ছোট ছোট শিশু, অন্তঃসত্ত্বা, বায়োবৃদ্ধরা আহত অবস্থায় নানাভাবে কষ্ট করে তারা এসেছে। তখন মানবিক কারণে আশ্রয় না দিয়ে আমরা পারিনি। তখন এটাও কথা হয়েছিল, এতগুলো মানুষ আসছে কীভাবে আমরা সাহায্য করব।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে অবশ্যই একটা চাপ পড়বে। তারপরও ভাসানচরে যে প্রজেক্ট নিয়েছি, আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট। ইতিমধ্যে কিন্তু আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। এরা যখন এসেছে, আমরা প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল থেকে আগাম টাকা দেয়া শুরু করে দিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষের কিন্তু মানবতাবিরোধ আছে। তারা প্রত্যেকেই ছুটে এসেছে। আমরা ডিসির নামে একটা ফান্ড করে দিয়েছি। সেখানে সব টাকা জমা হয়েছে। আমাদের সশন্ত্র বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছি, বিজিবিকে কাজে লাগিয়েছি। আমাদের পুলিশ বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছি। ভাগ করে করে দিয়ে কে কোন দিকটা দেখবে তা ঠিক করে দিয়েছি। সাথে সাথে তাদের আইডি কার্ড। এই আইডি কার্ড করার জন্য আগাম টাকা দিয়েছি। প্রজেক্টের জন্য অপেক্ষা করিনি। সে আইডি কার্ডে আলাদা একটা রঙ এর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এতে নিশ্চয় টাকা খরচ হয়েছে, কিন্তু আমরা মানবতার স্বার্থে খরচ করেছি। আমাদের দেশের ভেতর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ সাহায্য নিয়ে পৌঁছে গেছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবেও আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। ব্যাপকভাবে তারা এসেছে এবং সহযোগিতা করেছে, যে কারণ খুব একটা চাপ আমাদের ওপর পড়েনি। আমরা সহযোগিতা করছি বলেই সবাই এগিয়ে আসছে, তারা বলছে কী লাগবে বাংলাদশের। আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। আর তারা সহযোগিতা করছে বলেই মনে করছি এতটা সমস্যা হবে না। তা ছাড়া ভুলে যান কেন, বিএনপি আমলে ৬১ হাজার কোটি টাকা বাজেট ছিল। এখন চার লাখ কোটি টাকার বাজেট দিচ্ছি। কাজেই আমরা দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারব। আমাদের যেটা চাপ আছে, সেটা আমরা মোকাবেলা করতে পারব। আমার দেশের মানুষ প্রস্তুত। তারা ভাগ করে নেবে। আমাদের সে আতিথেয়তা আর মানবতাবোধ এখনও হারিয়ে যায়নি।’

‘শুধু রাজাকার, আল বদর আল শামস আর খুনি দিয়ে তো দেশটা না। সত্যিকারের যাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলী আছে, তারা কিন্তু এগিয়ে আসে। তারা কিন্তু জানে একজন দুঃস্থ মানুষের সাথে ভাগ করে খেতে। সে জন্য মনে করি না, আমাদের খুব বেশি অর্থনৈতিক সমস্যা আমাদের থাকবে।’

বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে সহযোগিতা করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী এও বলেন, একটা সময় এটা স্থিমিত হয়ে আসবে। তখন হয়ত প্রেসারটা আমাদের ওপর পড়বে। সে জন্য যত দ্রুত ফেরত পাঠাতে পারি, সে চেষ্টাটা করব। এ জন্য দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ভারত, রাশিয়া, চীনের নিজস্ব সিদ্ধান্ত আছে। সিকিউরিটি কাউন্সিলে তাদের ভূমিকা আছে। এর বাইরেও তারা সমর্থন দিচ্ছে।

‘আমাদের ভূমিকার কারণে সকলেই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, সকলেই কিন্তু মিয়ানমারকে চাপ দিচ্ছে এরা যাতে ফেরিয়ে চলে যাক। মিয়ানমারের সাথে যে চারটি দেশের বর্ডার আছে, চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস, তাদের সাথে আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলে যাচ্ছেন। আলোচনা করে যাচ্ছেন। তাদেরকে নিয়েই আমরা করতে যাচ্ছি।’

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031