জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল মিয়ানমারের রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে কক্সবাজার পৌঁছেছে । এই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করছে।
শনিবার বিকাল সাড়ে চারটা নাগাদ কুয়েত থেকে সরাসরি একটি চার্টার বিমানে করে ৩০ জনের প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজার বিমানবন্দর পৌঁছায়। এ সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খোরশেদ আলম তাদের স্বাগত জানান।
রবিবার সকালে প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ-মিয়ানমার শূন্যরেখায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দেখতে যাবে। এরপর তারা উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবেন। এদিন বিকালেই ঢাকায় ফিরবেন তারা। পরদিন (৩০এপ্রিল) এ দলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। সেদিন বিকালে তারা মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়বেন। মিয়ানমার সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবে প্রতিনিধি দলটি। পরে বিশেষ হেলিকপ্টারে করে তারা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করবেন।
প্রতিনিধি দলে রয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধিসহ নিরাপত্তা পরিষদের ১০ জন স্থায়ী প্রতিনিধি ও ৫ জন উপ স্থায়ী প্রতিনিধি। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিরাপত্তা পরিষদে পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি, যিনি একইসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিও।
শতকের পর শতক ধরে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয় না মিয়ানমার। গত চার দশক ধরে নিজেদের রাজ্যেও তাদের চলাচলের অধিকার ছিল সীমিত। এমনকি দেশটির শিক্ষা, চাকরি ও স্বাস্থ্য সেবায়ও তাদের প্রবেশাধিকার নেই।
১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের দেশটির নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করে দেশটির তৎকালীন সামরিক সরকার। তখন থেকে নিজভূমে সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের হাতে নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হতে থাকে রোহিঙ্গারা।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার কথিত অভিযোগ তুলে সেনা অভিযানের নামে নৃশংসতা শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এদের সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেমে আসা এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারে উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে।
জাতিসংঘ বলেছে, কথিত ওই হামলার আগে থেকেই সেখানে রোহিঙ্গাবিদ্বেষী প্রচারণা চলছে। বিশ্ব সংস্থাটি রোহিঙ্গা নিধনের বর্বর ঘটনাকে পাঠ্যপুস্তকের জন্য ‘জাতিগত নির্মূলের’ একটি উদাহরণ বলেও অভিহিত করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টির এক প্রতিবেদনেও ‘রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের সামরিক প্রচারণা’কে সেখানকার সংকটের জন্য দায়ী করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের স্রোত শুরু হওয়ার পর বিষয়টি জাতিসংঘে বাংলাদেশ তোলে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও প্রথমে রোহিঙ্গা নির্যাতনের কথা স্বীকার না করলেও পরে ‘কিছু হত্যার’ বিষয়টি স্বীকার করেন দেশটির সেনাপ্রধান।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রথমে সমঝোতা স্মারক এবং পরে ফিজিক্যাল অ্যারাঞ্জমেন্ট নামে চুক্তিও হয়েছে। প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপ হিসেবে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারকে আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকাও দেয়া হয়। যদিও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাইয়ের নামে সেখান থেকে মাত্র তিনশ জনের মতো রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক বলে দাবি করে।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে না নিয়ে নানা তালবাহানা করছে- একথা জানিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বাস্তবতায় রোহিঙ্গাদের জন্য মানসম্পন্ন আশ্রয় প্রকল্প নির্মাণে সরকারকে বিপুল অংকের টাকাও ব্যয় করতে হচ্ছে।