এখন আতঙ্কে বিশ্বজুড়ে একের পর এক ভূমিকম্পে মানুষ । আর এই আতঙ্ক থেকে বাদ যাচ্ছে না বাংলাদেশের মানুষও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঝে মধ্যে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার যে ভূকম্পন হচ্ছে তা বড় ভূকম্পেন ইঙ্গিত। আর এটিই এখন আতঙ্কের বড় কারন। অপরিকল্পিত নগরায়ন আমাদেরকে বিশেষ করে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে যে চিত্র পাওয়া যায় তা আঁতকে ওঠার মতো।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) গবেষণা রিপোটে বলা হয়েছে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভুমিকম্পে ধুলিস্যাৎ হতে পারে ৭০ ভাগ ভবন। এরমধ্যে স্কুল ভবনই সবচেয়ে বেশি। ফলে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ নগরায়ণে এ অঞ্চলে মাঝারি থেকে শক্তিশালী ভূমিক¤প হলে অধিকাংশ ভবনই টিকবে না। অথচ বৃহত্তর চট্টগ্রামে রিখটার স্কেলে ৭ বা ততোধিক মাত্রার শক্তিশালী ভূ-ক¤পনের আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু ভুমিকম্প মোকাবেলায় নেই কোন প্রস্তুতি ও কর্মপরিকল্পনা।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূ-স্তরে ৪টি বিপজ্জনক ফাটল লাইন প্রবল ভূমিক¤েপর দিকনির্দেশ করে। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সীতাকুন্ড এলাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নগরীর খুলশী, মোহরা, মদুনাঘাট এলাকা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালটেন্ট (ডিসিসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে বলা হয়, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড টেকনাফ ফল্ট বা ভূফাটল লাইন এবং রাঙ্গামাটির বরকল ফল্ট এবং মিরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ ভূ-ফাটল লাইন থেকে যে কোন সময় ৬ বা এর ঊর্ধ্বমাত্রায় ভূমিক¤প হতে পারে।
এছাড়া চট্টগ্রাম কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ভূমিক¤প গবেষণা কেন্দ্রের সাম্প্রতিক জরিপ রিপোর্ট অনুসারেও ভূস্তরের পাটাতনে ফাটলের কারণে ইউরোশিয়ান ও ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের ভূমিক¤েপর জোনের মধ্যেই রয়েছে চট্টগ্রাম। এ প্লেট দুটি অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ কারণে সম্প্রতি ঘন ঘন হালকা থেকে মাঝারি মাত্রায় ভূমিক¤প হচ্ছে।
সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ভূমিক¤প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম আলী আশরাফ বলেন, অতীতেও এ অঞ্চলে ভয়াবহ মাত্রায় ভূমিক¤প আঘাত হানে। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে রিখটার স্কেলে ৬.৯ মাত্রায় ভূমিক¤প হয়। আর এর উৎপত্তিস্থল চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ১৭০ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় চট্টগ্রামে া ঝাঁকুনি ছিল তুলনামূলক বেশি।
তিনি বলেন, ভূমিক¤েপ ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার বেল্ট বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূ-পাটাতনের (টেকটোনিক প্লেট) একটি ফাটল বা ফল্ট লাইন চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূল হয়ে আন্দামান পর্যন্ত চলে গেছে। অনেকগুলো ভূ-ফাটল লাইন, ভূমিক¤েপর উৎসস্থল (ইপি সেন্টার) চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে কাছাকাছি অবস্থানে সক্রিয় রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ছোট ছোট ভুমিকম্প শক্তিশালী ভুমিকম্পের পূর্বাভাস। যদিও ভূমিক¤েপর ক্ষেত্রে দিনক্ষণ-সময় সুনির্দিষ্ট করে পূর্বাভাস দেয়া আজও সাধ্যের বাইরে। তবে ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগত কিছু আলামত ভূমিক¤েপর আলামত বহন করে। যা থেকে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
চুয়েটের সদ্য বিদায়ি ভিসি মো. জাহাঙ্গীর আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, চট্টগ্রামে অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছভাবে, গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ উপায়ে যেনতেন প্রকারে নির্মিত বাড়িঘর, ভবনের হার শতকরা ৭৮ ভাগ। ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নকশা লঙ্ঘন করে অপরিকল্পিত, ত্রুটিপূর্ণভাবে এসব বাড়িঘর ও ভবন নির্মিত হয়েছে। যা মাঝারি-শক্তিশালী ভূমিক¤প হলে অধিকাংশ ভবন টিকবে না।
তিনি বলেন, ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভুমিকম্পে চট্টগ্রাম শহরের নির্মিত ৭০ ভাগ ভবন ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে। এরমধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে স্কুল ভবনগুলো। বিশেষ করে সরকারি বিদ্যালয় ও কেজি স্কুল ভবনগুলো অযতœ-অবহেলায় রয়েছে। ফলে ভুমিকম্পের চরম ক্ষতির মুখে রয়েছে শিশুরা।
সিডিএমপির জরিপ মতে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ১ লাখ ৮০ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্যিক ভবন ভূমিক¤েপ ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার মধ্যে ভূমিক¤প সংঘটিত হলে সেসব ভবন কম-বেশি বিধ্বস্ত হতে পারে।
খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) আওতায় দেশে প্রথমবারের মতো পরিচালিত একটি ডিজিটাল জরিপের ফলাফলে আইন লঙ্ঘন করে নির্মিত, ঝুঁকিপূর্ণ বসতঘর, বহুতল ভবন স¤পর্কে নাজুক চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ভূমিক¤প বিশেষজ্ঞ ড. এএসএম মাকসুদ কামালের জরিপ রিপোর্ট মতে, জনসংখ্যার অব্যাহত চাপে ক্রমবর্ধিষ্ণু চট্টগ্রাম মহানগরীতে অপরিকল্পিত, দুর্বল-ভঙ্গুর, কারিগরি নির্মাণ-ত্রুটি ও ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘরসহ বিভিন্ন ধরনের ভবনের হার দেশের অন্যান্য শহর নগরের তুলনায় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানসহ বেশকটি শহর ও শহরতলীতে নির্বিচারে পাহাড় টিলা কেটে খুঁড়ে ধ্বংস, গাছপালা সাবাড় করে ফেল অথবা পুকুর, দীঘি ভরাটের মাধ্যমে রাতারাতি বাড়িঘর, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন, কল-কারখানা স্থাপন করা হয়েছে ও তা অব্যাহতভাবে চলছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম ও এর আশপাশে, নগরীর পুরনো এলাকাগুলোতে জরাজীর্ণ বাড়িঘর এবং অন্যান্য জায়গায় নির্মিত অপরিকল্পিত, কারিগরি বিবেচনায় নির্মাণকাজে মারাতœক ত্রুটিপূর্ণ এমনকি নি¤œমানের বহুতল আবাসিক ও অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্যিক ভবনের প্রকৃত সংখ্যা সিডিএমপির জরিপে বর্ণিত সংখ্যার চেয়েও আরও অনেক বেশি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভের শক্তি নিঃসরণের মাত্রা বা চাপের উপর নির্ভর করে ভূমিক¤েপর মাত্রা এবং এর ফলে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কী হতে পারেÑএ বাস্তবতার আলোকে ভারতসহ ভূক¤পন-প্রবণ অঞ্চলের দেশসমূহ ভূমিক¤প সহনশীল অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং যাবতীয় নির্মাণকাজে ভূমিক¤প প্রতিরোধক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ ব্যাপারে স¤পূর্ণ পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছেন নীতিনির্ধারকরা।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে সাম্প্রতিককালে সংঘটিত ভূমিক¤েপর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর। তখন নগরীর কেন্দ্রস্থল হামজারবাগে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত একটি পাঁচতলা ভবন ধসে গিয়ে ২৫ জন নিহত হয়। ১৯৯৯ সালের ২২ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত মহেশখালী ভূমিক¤প, ২০০৩ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত রাঙ্গামাটির বরকল ভূমিক¤পটিও উল্লেখযোগ্য।