মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলি থেকে বাঁচতে ধানক্ষেত দিয়ে পালানোর সময় শেষবার নবি হোসেন তার বড় বোনকে দেখেছেন। কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে কখন যে দুই ভাইবোন আলাদা হয়ে গেলেন, টেরই পেলেন না তিনি। এই মুহূর্তে নবি হোসেন আছেন বাংলাদেশের একটি শরণার্থী শিবিরে। সঙ্গে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা। শরণার্থী শিবিরে আসার পর দিনের বড় একটি সময় ধুলোমাখা লাল রাস্তা ধরে বড় বোনের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান নবি। তার বিশ্বাস, তার বোনও হয়তো নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পেরেছেন।
তিনি বলেন, ‘হয়তো তিনি বাংলাদেশে। আমি হয়তো এখনও খুঁজে পাইনি তাকে।’ নবি হোসেনের রাবারের স্যান্ডেলে বালুতে ভরপুর। হয়তো আজও খুঁজে এসেছেন বোনকে। কিন্তু বোনের কোনো ছবি তার কাছে নেই। আছে শুধু চেহারার ছোট্ট ও অস্পষ্ট এক বর্ণনা: একটু বয়স্ক, কিন্তু এখনও তেজস্বী; হাসিখুশি।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামে তান্ডবলীলা শুরু করার পর ৭ মাস কেটে গেছে। প্রায় ৭ লাখ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখনও কয়েক হাজার মানুষ নিখোঁজ বা লাপাত্তা।
আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান্স ফর হিউম্যান রাইটসের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের মধ্যে ৪৩ হাজার জনের পিতামাতার অন্তত একজন নিখোঁজ। অনেকে আবার শিশু সন্তান হারিয়েছেন। কেউবা হারিয়েছেন ভাইবোন।
নিখোঁজ হওয়া রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে চলমান প্রত্যাবর্তন বিষয়ক আলোচনায় জটিলতা সৃষ্টি করেছে। ব্যাপকভাবে এই অভিযোগ রয়েছে যে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিখোঁজ মানুষদের খুঁজে পেতে সহায়তা করছে না।
মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে। অনেকে কয়েক প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করলেও সরকার তাদেরকে নাগরিকত্ব দিতে রাজি নয়। জাতিসংঘ বলেছে, মিয়ানমারের এই সামরিক অভিযানে গণহত্যার বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান। তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলছে, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসবাদের প্রতিক্রিয়ায় ওই অভিযান চালানো হয়েছে।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, নিহতদের সংখ্যা নিরূপনে সাহায্য করার বদলে, মিয়ানমার নিজেদের সম্পৃক্ততা লুকাতে হত্যাযজ্ঞের ঘটনাস্থল বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, নবি হোসেনের গ্রাম আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মিয়ানমার সরকার বলেছে, সম্ভাব্য অপরাধ ধামাচাপা দিতে ওই গ্রামগুলো বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। বরং, যাদেরকে প্রত্যাবর্তন করা হবে, তাদের জন্য বাড়িঘর বানাতেই তা করা হয়েছে।
বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে’র পরিচালক মার্ক ফার্মানের বলেন, পৃথক হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোকে এক করতে মিয়ানমার একেবারে কিছুই করেনি। সরকারের পক্ষ থেকে এটি পুরোপুরি হৃদয়হীন কাজ।
মিয়ানমারের শীর্ষ বেসামরিক নেতা অং সান সু চির মুখপাত্র জ হতায় বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ব্যতিত নিহত ও নিখোঁজ লোকজনের সংখ্যা নিরূপন করা সম্ভব নয়। কারণ, শুধু শরণার্থীরাই জানবেন তাদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কারা নিখোঁজ হয়েছেন।
রেডক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটির প্রতিনিধি মেলিসা ডামিগনার্ড বলেন, পৃথক হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদেরকে একসাথ করতে তার সংগঠন কাজ করছে। তবে কোনো সরকারি তালিকা না থাকায় বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।
শরণার্থীরা নিজ চেষ্টায় স্বজনদের খোঁজার চেষ্টা করেছেন। মুখে মুখে কথা ছড়িয়ে চেষ্টা করে দেখেছেন কোনো খোঁজ মিলে কিনা। কিন্তু শরণার্থী শিবিরগুলোতে এখন হাজার হাজার তাঁবু। শিবিরে প্রথমে মাইক সমেত বুথ তৈরি করা হয়েছিল যাতে পিতামাতারা এসে নিখোঁজ সন্তানের শারীরিক গড়নের বর্ণনা দিয়ে সন্ধান চাইতে পারেন। এছাড়া অস্থায়ী মসজিদও এসব বার্তা ছড়াতে ভূমিকা রেখেছে।
এমন একটি বুথ নির্মাণ করেছিলেন কামাল হোসেন। তার অনুমান, তার বুথের মাধ্যমে অন্তত কয়েকশ’ পরিবার হারিয়ে যাওয়া স্বজনকে খুঁজে পেয়েছে। এই সংখ্যা সাহায্যপ্রার্থীদের প্রায় অর্ধেক। তবে খুঁজে পাওয়ার হার একেবারে কমে যাওয়ায় ফেব্রুয়ারিতেই ওই বুথ বন্ধ করে দেন কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় বাকি যাদেরকে পাওয়া যায়নি তারা জীবিত নেই। অনেক মাসই তো হয়ে গেল।’
তবে নবি হোসেন এখনই হাল ছাড়তে রাজি নন। তিনি একজন কৃষক। বড় দাড়ি গালে। মা মারা যাওয়ার পর বড় বোনই ছিল তার সবকিছু। বোনটির নাম সামারুক। মায়ের মৃত্যুর পর, বাবা যখন দিনের বেলায় ক্ষেতে কাজ করতে যেতেন, বোনই তকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। গোসল করিয়েছেন। চুল আঁচড়ে দিয়েছেন সকালে। রমজান মাস শেষ হলে গুড় পিঠা তৈরি করে খাইয়েছেন। নবি হোসেনের ভাষ্য, ‘তিনি আমাকে বোনের ও মায়ের দু’জনের ভালোবাসাই দিয়েছেন।’
গত সেপ্টেম্বরে যখন তাদের গ্রামে সহিংসতা শুরু হয়, নিরাপত্তা বাহিনী পুরো এলাকায় অভিযান চালায়। কয়েকজন গ্রামবাসীকে তারা গুলিবিদ্ধ করে। নবী হোসেন বলেন, গুলিবিদ্ধদের মধ্যে তার বোন সামারুকের একমাত্র কন্যাশিশু সন্তানটিও ছিল। বেঁচে ছিলেন নবি হোসেন, তার স্ত্রী, ছেলে, বোন ও বোনের স্বামী। অন্য শ’ শ’ গ্রামবাসীর মত তারাও বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে যান।
নবী হোসেন ও তার ছেলে বলেন, পলায়নরত গ্রামবাসীরা যখন সীমান্তবর্তী নাফ নদীর দিকে এগিয়ে আসেন, তখনই তাদেরকে অ্যামবুশে ফেলে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। সেনারা যখন গুলি ছুড়ছিল, সবাই তখন যেদিকে পেরেছেন পালিয়েছেন। তখন বয়স্করা পিছনে পড়ে যান।
নবি হোসেনের ছেলে কয়েক ঘণ্টা বাদে তাদেরকে খুঁজতে বের হন। কিন্তু সামারুক ও তার স্বামীকে আর পাওয়া যায়নি। সৈন্যরা এগোতে থাকায় খোঁজার চেষ্টা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যরা। আশা ছিল, বাংলাদেশে গিয়ে হয়তো আবারও দেখা হবে বোনের সঙ্গে। নবি হোসেন এখন বলছেন, ‘এটাই আমার মধ্যে অপরাধবোধের জন্ম দিয়েছে। মানুষ সেনাদেরকে দেখেই আপন প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌঁড় দিয়েছে।’
নবি হোসেন জানেন যে, শরণার্থী শিবিরে বোনকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবুও নিজের স্ত্রীর কানের দুল বিক্রি করেও বোনকে খোঁজা অব্যাহত রেখেছেন তিনি।
কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে তিনি একদিন দেখতে পান কিছু বয়স্ক লোক হলুদ তারপুলিনের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছে। নবি হোসেন সিদ্ধান্ত নিলেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন তার বোনের মতো বা বোনের জামাইর মতো কাউকে তারা দেখেছেন কিনা। নবি হোসেন জিজ্ঞেস করেন, ‘কেউ কি ওই পাড় থেকে এসেছেন?’ উপস্থিত লোকেরা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। তাদের একজন বললেন, নবির সাথে তার আগেও দেখা হয়েছিল। তখনও নবি একই প্রশ্নই জিজ্ঞেস করেছিলেন। অনেকটা স্বান্তনা দেওয়ার সুরে লোকটি বললেন, ‘আমরা সবাইই কাউকে না কাউকে হারিয়েছি।’
(ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন ‘অ্যাজ হোপ ফেইডস, রোহিঙ্গা রিফিউজিস সার্চ ফর দ্য মিসিং’ অবলম্বনে।)