চার বছরের এমবিবিএস কোর্স করে ইন্টার্নশিপ শেষ করে চিকিৎসকের সনদ পেয়েছেন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি। কিন্তু পরে ছেড়ে দেন তাও। এখন দৃশ্যত কোনও পেশা নেই। তাতে অবশ্য রাজধানীতে স্বচ্ছল জীবন চালাতে সমস্যা হচ্ছে না ইমরান এইচ সরকারের।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের কারণে ওই আন্দোলনের কর্মী ইমরান এখন সারা দেশের এক পরিচিত মুখ। শুরুর দিকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতস্ফুর্ত সমর্থন পায় এই আন্দোলন। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই বিরোধ তৈরি হয় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের মধ্যে। ফল, বিভক্তি, দুই ভাগ হয় সংগঠন। বিরোধিতার অন্যতম কারণ আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতা।
এরপর আরও বিভক্তি। পাশাপাশি গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে কট্টর ধর্মীয় গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন, রক্তক্ষয়ী ঢাকা অবরোধ আর ‘ধর্মবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের ওপর জঙ্গি হামলা। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে যোগ হয় নানা মাত্রা।
এক পর্যায়ে ইরমান এইচ সরকারের পরিচয় হয়ে উঠে গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের নেতা হিসেবে। তার বিপক্ষের অংশ অবশ্য সেভাবে সক্রিয় নন। গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধীদের মতো ইমরানের সাবেক কর্মীরাও তার বিরুদ্ধে তুলছেন স্বেচ্ছাচারিতা, আন্দোলনকে নিজের উচ্চভিলাস চরিতার্থ করার পটভূমি হিসেবে ব্যবহার আর আর্থিক অনিয়মের মত গুরুতর অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে কোনও কাজ না করেও ইমরানের স্বচ্ছল জীবন যাপনকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা।
ইমরান অবশ্য কোনও ধরনের অনিয়ম, অসততার অভিযোগ স্বীকার করছেন না। তার দাবি, ব্যক্তিগত আক্রোশ আর অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই তার বিরুদ্ধে নানা কথা বলা হয়। নিপীড়িত মানুষের পক্ষে আজীবন কথা বলে যাবেন-আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই এমন কথা বলেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র।
পেশাহীন ইমরানের ‘স্বচ্ছল’ জীবন
রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পেছনে চার কক্ষের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন ইমরান এইচ সরকার। ওই এলাকায় চার কক্ষের একটি বাড়ির ভাড়া প্রতি মাসে কমসে কম ৫০ হাজার টাকা। ঘরের আসবাবপত্রও বেশ রুচিশীল, নজরকাড়া। এগুলোর দাম যে সাধারণের নাগালের বাইরে, তা দেখেই বোঝা যায়।
এই ফ্ল্যাটে অবশ্য ইমরানের পরিবারের সদস্যরা থাকেন না। বরং গণজাগরণ মঞ্চের কয়েকজন কর্মী তার সঙ্গে সেখানে থাকেন।
চলাফেরার জন্য সাদা রঙ এর একটি প্রাইভেট কার আছে ইমরানের। তার ভাষায়, ‘গণপরিবহণে চলাচল করা আমার জন্য কষ্টকর’।
-কারণ কী?
-‘যেখানেই যাই, আমাকে ঘিরে ধরে মানুষ। একবার ব্যক্তিগত গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেলো, একটি অটোরিকশা ভাড়া করতে গেলাম, তখনই মানুষের ভিড় তৈরি হয়ে গেলো। এ রকম ভিড় হলে নিরাপত্তার সমস্যাও থাকে। তাই ব্যক্তিগত গাড়িতেই চলতে হয়’।
-আপনাকে তো সরকারি নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে…
-‘টেলিভিশনে পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বক্তব্য থেকে এ বিষয়টি জেনেছি। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুয়া কথা। আমাকে কখনও সরকারি নিরাপত্তা দেয়া হয়নি। যখন আন্দোলন তুঙ্গে তখন একটি ভাঙাচোরা মাইক্রোবাসে করে আমাদের কয়েকজনকে বাসায় নামিয়ে দেয়া হতো’-বলে যান ইমরান।
এক প্রশ্নের জবাবে ইমরান এইচ সরকার জানান, তার ব্যক্তিগত গাড়িটির কোনও চালক রাখেননি তিনি। নিজেই চালান সেটি। এতে একটি খরচ বেঁচে যায় তার।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারেই জন্ম আর বেড়ে উঠা ইমরান এইচ সরকারের। চিকিৎসা বিদ্যা পড়েছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখন পড়াশোনার পাশাপাশি ছিলেন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা। সে পরিচয় অবশ্য এখন গৌণ।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনের আর সেভাবে আমেজ নেই। তবে সামাজিক, রাজনৈতিক নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন ইমরান, নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চ। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টা মামলায় সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তারের পর এ নিয়ে তীর্যক ভাষায় সরকারকে আক্রমণ করেন ইমরান এইচ সরকার। এর প্রতিক্রিয়ায় ইমরানের কঠোর সমালোচনা করেন জয়।
আর এই পর্যায়ে ইমরানকে ঘিরে তৈরি হয় নতুন আলোচনা। তাকে ফেসবুকে ‘আনফ্রেন্ড’ ও ‘আনফলো’ করতে প্রধানমন্ত্রী পুত্র জয়ের আহ্বানের পর ইমরানের কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন সরকার সমর্থকরা। আবার ইমরানের কট্টর বিরোধী বিএনপি-জামায়াতপন্থীর কেউ কেউ এখন আবার তার পক্ষ নিয়েছেন। এই পক্ষ থেকে এখন ইমরান এইচ সরকারকে ফলো করার আহ্বানও এসেছে।
এই পর্যায়ে এসে ইমরানের ব্যক্তিগত জীবন আর আয়ের উৎস্য নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন। চাকরি না থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি এখন কোথাও চাকরি করছি না। তবে লেখা-লেখি করে জীবিকা নির্বাহ করছি।’
-কোথায় কী লিখেন? কেমন সম্মানী পান?
-‘সুনির্দিষ্ট কোনও একটি জায়গায় লিখি না। নানা বিষয় নিয়ে একাধিক পত্রিকা আর পেজে লিখি। বিনিময়ে যা পাই তা দিয়ে আমার চলে যায়’।
-লেখা-লেখিতে কী এতো টাকা আয় করা সম্ভব?
-‘বাকি টাকা পরিবার থেকে যোগান দেয়া হয়’।
শিক্ষা জীবন আর চাকরিজীবনে লেখালেখি করতেন ইমরান। সাড়ে চার হাজার মানুষকে হত্যার মামলায় ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের পর যখন গোটা দেশ ক্ষুব্ধ তখন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম নামে একটি সংগঠন শাহবাগে ফাঁসির রায় চেয়ে মানববন্ধন ডাকে। পরে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয় তারা আর প্রতি মুহূর্তে বাড়ে জনস্রোত। এক পর্যায়ে সারা দেশে গড়ে উঠে গণ আন্দোলন। আর এই আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে ইমরান এইচ খানের নাম ঘোষিত হয়।
এই মুখপাত্র হিসেবে নাম ঘোষিত হওয়ার পর ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের পদ থেকে ইস্তফা দেন ইমরান। ওই থেকে আর ওই পেশায় ফেরেননি তিনি।
গণজাগরণ মঞ্চের তহবিল নিয়ে নানা অভিযোগ
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে দেশ-বিদেশ থেকে শুভানুধ্যায়ীরা অনুদান দেন। তবে কত টাকা কে দিয়েছেন সে পরিমাণটা কখনও প্রকাশ করা হয়নি। আর এই টাকা কখন কোথায় খরচ হয়েছে-সেই প্রশ্নে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের মধ্যে তৈরি হয় বিরোধ।
কেবল গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় নয়, দুই বছর আগে সাভারের রানাপ্লাজা ধসের পর হতাহতদের পরিবারের সহায়তার জন্য চাঁদা তোলা হয় গণজাগরণ মঞ্চের নামে। সেই টাকার ব্যবহার নিয়েও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়ায় মঞ্চের কর্মীরা। ইমরানের বিরোধী পক্ষ প্রকাশ্যেই অনুদানের টাকা অপব্যবহার আর আত্মসাতের অভিযোগ তুলছেন মঞ্চের মুখপাত্রের বিরুদ্ধে।
ইমরান অবশ্য বরাবর এসব অভিযোগকে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা বলছেন। এর তেমন কোনও জবাবও কখনও দেননি তিনি।
গণজাগরণ মঞ্চে বিভেদের পর মঞ্চ থেকে আলাদা হয়ে নানা কর্মসূচি পালন করে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড নামে একটি সংগঠন। এর ত্রাণ, দুর্যোগ ও পুনর্বাসন সম্পাদক মাকসুদা সুলতানা ঐক্য তখন থেকেই ইমরানের আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতার অভিযোগ করে আসছেন। ঐক্য বলেন, ‘ইমরান ঢাকায় যেভাবে থাকেন তাতে লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। তিনি কী লেখা-লেখি করে যে এই পরিমাণ আয় করেন? আসলে তিনি কোনও লেখালেখাই করে না’।
ঐক্য বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের সময় এক ঘণ্টায় ৬৫ কোটি টাকা চাঁদা উঠেছে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়ও কোটি কোটি টাকা উঠেছে। এর বেশিরভাগই আত্মসাৎ করেছেন ইমরান’।
ঐক্য বলেন, ‘২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল আমরা টিএসসিতে বসে ইমরানের কাছে টাকার হিসাব চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই টাকার হিসাব আজও দিতে পারেনি ইমরান। তখনকার আত্মসাৎ করা টাকা দিয়েই এখন আয়েশি জীবন-যাপন করছেন ইমরান’।
ঐক্যের এই অভিযোগের বিষয়টি পক্ষ থেকে তোলা হয় ইমরান এইচ সরকারের কাছে। তিনি বলেন, ‘এগুলোর সবই বানোয়াট এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আমাকে হেয় করার জন্যই এসব অভিযোগ তোলা হয়েছে। এসব অসত্য অভিযোগের কী জবাব দেবো? শুরু থেকেই আমার কাছে প্রতিটি টাকার হিসাব ছিল এবং আমি তা কর্মীদের দিয়েছিও’।
-‘গণজাগরণ মঞ্চের সাবেক কর্মীরা কেন আপনার বিরুদ্ধে অর্থ লোপাটের মিথ্যা অভিযোগ করতে যাবেন?’।
-‘যারা অভিযোগ তুলছে তারা আমাদের সঙ্গে নেই। আর এখন সুযোগ বুঝে এসব বলছে’।-ঢাকাটাইমস