ছেলেটি স্বপ্ন দেখায় বিয়ের। ভালোলাগা থেকে প্রেম। সেখান থেকেই স্বপ্ন বুনন।মেয়েটিও সে স্বপ্নে বিভোর থাকে। ঘর করার প্রলোভন থেকে শুরু হয় আরো ঘনিষ্ঠতা। শুধু তাই নয়, বিয়ের আগেই ছেলেটির প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন অনেকে।

কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই এতে নেমে আসে বিপর্যয়। একপর্যায়ে সম্পর্কে ভাঙন। সব স্বপ্ন শেষ। বিয়ের প্রলোভনে পড়ে যাকে সর্বস্ব দিয়ে দিলো সে ছেলেটি করলো প্রতারণা। কেউ কেউ এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে ‘ধর্ষণের’ মামলাও করেন। দিন দিন এমন ঘটনা বাড়ছে। আইনজীবীরা বলছেন, এ ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতারণার মামলা হয়। ধর্ষণের মামলা হয় না। গত ৪ঠা মার্চ সাভারের ধামরাইয়ে ইমরান নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে পার্শ্ববর্তী বাসার একটি মেয়েকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। মেয়েটি ৩০ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বাও ছিল। এ নিয়ে মেয়েটির বাবা থানায় মামলাও করেন। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল সে সময়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ফেনীর সোনাগাজীতে আল আরাফাহ্‌ মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট শাখার এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। জানা যায়, উপজেলার মমতাজ মিয়ার বাজারে আল-আরাফাহ্‌ মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট শাখায় কর্মকর্তা হিসাবে ২০১৬ সালের ২১শে জুন নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামের এক নারী (১৯) যোগদান করেন। তার যোগদানের দেড় মাস পর ছাগলনাইয়া উপজেলার পৌর এলাকার মটুয়া গ্রামের নুরুল হকের ছেলে ওমর ফারুক মানিক (২৮) ওই শাখায় শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরু করেন। চাকরির সুবাদে মানিক ওই নারীকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। একপর্যায়ে দু’জনের মন দেয়া- নেয়াও হয়। সম্পর্কের এক পর্যায়ে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে মানিক ওই নারীকে ব্যাংকের কার্যালয়ে এবং ওই নারীর বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয়। পরে ওই নারী মানিককে বিয়ের জন্য চাপ দিলে মানিক বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে ভুক্তভোগী ওই নারী সোনাগাজী থানায় ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা করেন। চলতি মাসেই খুলনার দৌলতপুরে এক কলেজছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দিনের পর দিন শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে রানা হাওলাদার (২৪) নামে এক যুবক। একপর্যায়ে দুজনের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় রানা মেয়েটির নগ্ন ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। ঘটনার বিস্তারিত জানতে গিয়ে জানা যায়, দৌলতপুর এলাকায় কলেজ পড়ুয়া (১৭) মেয়ে মোবাইল ফোনে গান ও গেমস আপলোড করতে গিয়ে রানার সঙ্গে পরিচয় হয়। একপর্যায়ে রানার সঙ্গে মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সুযোগে রানা মেয়েটিকে বিয়ের লোভ দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। রানা মেয়েটির অশ্লীল ছবি গোপনে মোবাইল ফোনে ধারণ করে। মেয়েটি বিয়ের কথা বললে রানা অশ্লীল ছবি দেখিয়ে মেয়েটিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বিয়ে না করার টালবাহানা শুরু করে। এতে মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পরিবারের মধ্যে বিষয়টি জানাজানি হয়। পরবর্তীতে এলাকাবাসী কয়েকবার সালিশ বৈঠক করে। কিন্তু রানা কিছুতেই মেয়েটিকে বিয়ে করবে না। পরে থানায় মামলা করে দেয় মেয়েটির বাবা।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মাহমুদ আলীর সঙ্গে ওই কলেজছাত্রীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে মাহমুদ আলী বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়। এই অবস্থায় কলেজছাত্রী গর্ভবতী হলে বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর বিয়ের দাবিতে গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি রাতে ওই ছাত্রী মাহমুদের বাড়িতে গিয়ে উঠলে ওই বাড়ির লোকজন ঘরে তালা দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে ধর্ষণের অভিযোগ এনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। এ ধরনের ঘটনা সমাজে হরহামেশায় ঘটছে বলে উদ্বিগ্ন সবাই। ঘটনার সঙ্গে মামলা হচ্ছে। অনেকে সেসব মামলায় শাস্তিও ভোগ করছেন। তবে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হলেও সেটি ধর্ষণ নয় বলে জানিয়েছেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আইনজীবী পারভীন আক্তার খানম। তিনি জানান, এ ধরনের অভিযোগগুলোকে সাধারণত প্রতারণার মামলার আওতায় আনা হয়। ৪২০ ধারায় এর শাস্তিও বলবৎ রয়েছে। পারভীন আক্তার খানম বলেন, বিয়ের প্রলোভনে কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তাতে যদি ছেলেটি অস্বীকৃতি জানায় সেক্ষেত্রে সেটি প্রতারণার মামলার আওতায় আনা হয়। আমরা মামলাগুলো নিয়ে সেভাবেই কাজ করি। এ ধরনের অপরাধে ৪২০ ধারায় দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এ বিষয়ে মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারম্যান সিগমা হুদা বলেন, আমাদের সমাজে এ ধরনের সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর জন্য অনেকটা চলমান সমাজ ব্যবস্থাও দায়ী। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের বিশেষ করে পরিবারের অভিভাবকদের বেশি সতর্ক হতে হবে। না হলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে চলমান এ সমস্যা দিন দিন আরো বাড়তেই থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, মূলত তিনটি কারণে এ ধরনের ঘটনা আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। প্রথমত অবাধভাবে, স্বাধীনভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সাইট বন্ধ করে দেয়া আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দ্বিতীয়ত বিচারহীনতা সংস্কৃতি। আমাদের দেশে এ ধরনের অপরাধে সুষ্ঠু বিচার হয় না। হলেও সেটা কম। তাই অনেকেই মনে করে এ কাজ করে সে কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যাবে। আর শেষ যেটা বলবো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। একটা সময় আমাদের পরিবারের অভিভাবকগণ যেভাবে সন্তানদের ভালো-মন্দে ভূমিকা রাখতেন কিংবা যে পারিবারিক বন্ধন ছিল সেটা কমে গেছে। এমনকি শিক্ষকরাও এক ধরনের ভূমিকা পালন করতেন। কিন্তু সেই সংস্কৃতি এখন নেই বললেই চলে। পারস্পরিক বন্ধনের অভাবে এ ধরনের ঘটনাগুলো অহরহ ঘটছে।
Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031