বাস্তবায়ন করা যায়নি মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই বাছাই করে ৪৮ তম স্বাধীনতা দিবসের আগেই একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের ঘোষণা।

যাচাই বাছাই করে ভুয়াদের বাদ দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে গিয়ে উল্টো মামলার কবলে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

একটি দুটি নয়, প্রায় ছয়শ মামলা হয়েছে যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে।

‘নির্ভুল’ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে যাচাই বাছাই কাজ শুরু করে সরকার। একই সঙ্গে নেয়া হয় নতুন আবেদন।

অনলাইনে ও সরাসরি আরও দেড় লাখ আবেদন জমা পড়ে। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে প্রায় ২৫ হাজার নাম পাঠানো হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এসব সুপারিশেও ত্রুটি পেয়েছে। তারা বড়জোর হাজার পাঁচেক ব্যক্তির নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে ভেবেছিল।

কিন্তু আবেদন বাতিল করতে গিয়ে বা তালিকায় থাকা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ দিতে গিয়েই মামলার শিকার হচ্ছে মন্ত্রণালয়।

সব মিলিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৫৮৬টি, এরমধ্যে শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই হয়েছে ৩৭৪টি।

এসব মামলার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা যেমন তৈরি করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না বলে ‘অসহায়ত্ব’ মন্ত্রণালয়ের কণ্ঠে।

গত ২১ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, বর্তমান সরকারের আমলেই একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার বিষয়ে আশাবাদী তারা।

মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ

সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত দলিলের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার ও সাব-সেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশিত বইয়ে নিয়মিত বাহিনীর ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর ১ লাখ ৭ হাজারসহ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গণ্য করা হয়।

তবে এর বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন বাহিনী ছিল যারা স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধ করেছে।

তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ১৩ বছর পর প্রথমবারের মতো করা হয় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা। ১৯৮৪ সালের প্রথম তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিলো ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন। তবে সে সময় বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার বাদ পড়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠে।

বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের নির্বাচনকে সামনে রেখে যে ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়, এতে সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৮৬ হাজার।

আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দুই দফায় যাচাই বাছাই করে এক লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে। এখন পর্যন্ত ওই তালিকাটিকেই সবচেয়ে অবিতর্কিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিএনপি সরকার (২০০১-২০০৬) ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে সংযোজনের পর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দুই লক্ষ ১০ হাজার। এই তালিকায় বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত নেতাদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম উঠে।

আওয়ামী লীগ সরকার আবার (২০০৯-২০১৪) ক্ষমতায় এলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লক্ষ ১৫ হাজার। আর গেরিলা যোদ্ধাদের নাম সংযোজন নিয়ে, বিশেষ করে বামপন্থী রাজনৈতিকদের একটি মামলা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।

মামলার জটিলতা

২০১৭ সালে যাচাই বাছাই শুরু হওয়ার পরই শুরু হয় জটিলতা। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল এ সংখ্যাকে ২৫ হাজারে নামিয়ে আনার পর যাদেরই অবেদন বাতিল করা হয়, তারাই আদালতের গিয়ে একের পর এক মামলা করতে থাকেন। ফলে থমকে যায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করার কার্যক্রম।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) মহাপরিচালক মিজানুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির সাক্ষর জাল করে কেউ যদি আবেদন করে যদি সেটা বাতিল করি। এমন মিথ্যা মামলায় আমাকে তিন বছর ঝুলিয়ে রাখল।’

মামলার সংখ্যা অর্ধসহস্রাধিক, দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়ানো। তাই সবগুলো মামলাকে একটি আদালতে এনে ফয়সালা করার প্রস্তাব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। আর মামলা কারণে স্থগিত আছে ১১৬টি উপজেলার কার্যক্রম।’

এর কারণ হিসেবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যে নীতিমালা করেছিলাম আমাদের কাছে মনে হয়েছে অনেকেই নীতিমালা লঙ্ঘন করে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। কারণ এতো সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা লেফট আউট থাকার কথা না।’

এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘নতুন যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তারা বসে সিদ্ধান্ত নেবেন কী প্রক্রিয়ায় এটা দেয়া যায়।’

তবে যারা ভুয়া অবেদন যারা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্টি মফিদুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের যেনো শাস্তি দেওয়া হয়। যেনো এমন পবিত্র বিষয় নিয়ে কেউ অসাধু কার্যক্রম না চালায়।’

তালিকা প্রণয়ন কার্যক্রম স্থগিত

২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে কমিটি করার গেজেট প্রকাশ করা হয়। এসব কমিটিতে স্থানীয় সাংসদ, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ মন্ত্রণালয় বা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিনিধি ছিলেন।

৪৭২টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি কাজ শুরু করে ওই বছরের ২১ জানুয়ারি। এর মধ্যে ৩৬৫টি কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে, বাকি প্রতিবেদনগুলো জমা পড়েনি।

জমা হওয়া প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালককে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি ১১ মার্চের জামুকার সভায় জানিয়ে দিয়েছে, প্রতিবেদন ও তালিকা আরও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই তালিকা চূড়ান্ত করতে না পারাটা দুঃখজনক। এটা তেমন কঠিন কাজ ছিল না।

‘আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, আমলানির্ভর তালিকা প্রণয়ন কখনোই সম্ভব নয়। এ যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, সে জন্য আমরা লজ্জিত।’

‘রাষ্ট্রীয় অর্থ, এত মানুষের শ্রম ও সময় খরচের পরও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা গেল না, এটা খুবই দুঃখজনক।’

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031