অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার ইস্যুতে কথা বললেন। তিনি বললেন, মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের সন্তান ও নাতি-পুতির জন্য বরাদ্দকৃত কোটা কমবে না। তবে শূন্য পদে মেধাবীদেরকে সুযোগ দেয়া হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করেছিলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতিনদের জন্য কোটা সুবিধা রহিত করার কথা বলবেন। কিন্তু তিনি যেহেতু পুতি শব্দটা উচ্চারণ করেছেন, তাই আমি ধরে নিয়েছি তিনি নাতি-নাতিনের পর পুতি পর্যন্ত সুবিধা প্রদানের কথা বলেছেন।
কোটা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে অনেক ভাবার পরে আমি আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত, তিনি যে পুরো বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল, সেটি এখন পরিষ্কার। ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীল আন্দোলনের বার্তা দেশের প্রধান ব্যক্তির দরবারে পৌঁছেছে, এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরা নিজেদের আন্দোলন গুছিয়েছে। ফেসবুককে ব্যবহার করে সারাদেশে নিজেদের বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। দেশের মূলধারার অনেক সংবাদমাধ্যম বিশাল এই ছাত্র আন্দোলনের কাভারেজ দেয়নি। ছাত্র-ছাত্রীরা একের পর এক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে গেছে। পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাসও এদেরকে ভায়োলেন্ট করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত দেশের বড় অনেক বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক কিংবা রাজনৈতিক নেতা এত বড় শিক্ষার্থী আন্দোলন নিয়ে একবারের জন্যও মুখ খোলেন নি। এরপরেও বার্তা গেছে জায়গা মত। এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিক্রিয়ায় এমন কিছু বলেছেন, যাতে আমি মোটেও হতাশ নই। বরং আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।
দ্বিতীয়ত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারি চাকরিতে শূন্যপদে মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হবে। কোটা সুবিধা একটা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার দাবি ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোটা কমানো হবে না। কিন্তু শূন্যপদে মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হবে। এখানেই আমি সবচেয়ে বেশি আশান্বিত। ধরা যাক, কোনো এক বিসিএসে ৫০০ নতুন অফিসার নেয়া হবে। বর্তমান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার হিসেবে ১৫০ অফিসার নিয়োগ পাবে মুক্তিযোদ্ধার পরিবার থেকে। কিন্তু বাস্তবে পাওয়া গেল ৫০ জন। ফাঁকা থাকবে ১০০টি পদ। এই ১০০টি পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া যাবে। উপজাতি (অবাঙালি বাংলাদেশি জাতিগোষ্ঠী) কোটা বা অন্য কোনো কোটায় শূন্য পদ থাকলে সেগুলোতেও কোটাবিহীনদের নিয়োগ দেয়া হবে। ফলে মেধাবীদের সুযোগ কিন্তু বেড়ে গেল।
সব মিলিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর কথায় আমি আশাবাদী। তাঁর উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আমি বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় সামনের দিনগুলোতে কোটা সংস্কার নিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত জানাবেন। সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা কোটার উপরই ফোকাস করেছেন। কারণ সবচেয়ে বেশি কথা হচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা (৩০ পারসেন্ট) নিয়েই। যদিও সংস্কারপন্থীদের দাবিসমূহ কখনোই মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কেন্দ্রীভূত ছিল না। কিছু মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার করেছে, এই আন্দোলন নাকি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী। এমনকি দেশের তরুণ সমাজের প্রায় সবাইকে ‘শিবির’ বলে প্রচার করেছে একটি মহল। অথচ সংস্কার চেয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ছাত্রলীগের নেতা ও প্রগতিশীল সমাজকর্মীরাও আছেন। তাছাড়া যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা ছাত্রলীগ নেতা নন, তারা সবাই কেন ‘শিবির’ হতে যাবেন? আন্দোলনের সাথে প্রকাশ্যে হাজার হাজার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ছেলে-মেয়ে আছে। সবাইকে ঢালাওভাবে শিবির বলে কোটাপন্থীদের একটা অংশ মূলত শিবিরের মার্কেটিং করেছেন। এত ছেলে-মেয়ে শিবির করে, এটা শিবিরও বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি কখনোই এদেশে মূলধারা হতে পারবে না। দেশের মানুষকে চিনতে ভুল করা যাবে না।
কতটা স্বার্থপর হলে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের একটা অংশ নিজেদের স্বার্থের জন্য দেশের সবচেয়ে মেধাবী লাখ লাখ ছেলে-মেয়েদেরকে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করতে পারে! আওয়ামী লীগ কি শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, নাতি-নাতিন আর পুতিদের ভোটে জেতে? আর মুক্তিযোদ্ধা কে? এ পর্যন্ত কতবার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পাল্টানো হয়েছে, সে হিসেব আছে? মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা হয়েছিল জাতির বীর সন্তান ও তাঁদের পরিবারবর্গকে পুনর্বাসন করার জন্য। এত মহান একটা প্রক্রিয়ার অবৈধ সুযোগ নিতে আমরা করলাম কী? সনদ ম্যনেজ করার জন্য ঘুষের কারবার শুরু করলাম। ১৯৭৪ সালে জন্ম নেয়া একজন মানুষ, তিনিও এখন সনদধারী মুক্তিযোদ্ধা! খোদ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী প্রায় প্রতিদিন এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু দুষ্টচক্রের সাথে পেরে উঠছেন না।
একজন মুক্তিযোদ্ধা যিনি ১৯৭১ সালে নিজের জান বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, শহীদ হয়েছেন বা গাজী হয়ে বেঁচে আছেন, তিনি সবসময় একই রকম মহান নাও থাকতে পারেন। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক তো বিএনপি, জাতীয় পার্টি করেন; এমনকি জামাত দাবি করে, তাদেরও একটা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট আছে!! কাদের সিদ্দিকির মত বঙ্গবীর এখন মৌলবাদীদের সুরে কথা বলেন। নারী নেতৃত্ব নিয়ে কাঠ মোল্লাদের মত কথা বলা শুরু করেছেন তিনি। সর্বশেষ তিনি বলেছেন, নারী নেতৃত্ব দিয়ে দেশে নাকি আল্লাহর রহমত আসবে না! বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিতে দেশ স্বাধীন করে এখন তিনি অশিক্ষিত ধর্মব্যবসায়ীদের মত কথা বলছেন। যেনতেন ভাবে শেখ হাসিনার সরকারকে কোণঠাসা করতে চাইছেন। এখন কাদের সিদ্দিকি কি আগের মত সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখেন? অন্যদিকে যে মানুষটি ১৯৭১ সালের পরে জন্ম নিয়েছেন কিংবা ১৯৭১ এ বাচ্চা ছিলেন, তাঁর সন্তান এখন কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তিনি যদি এখন দেশকে ভালোবাসেন, সততার সাথে কাজ করে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন তাহলে তিনিই এখন আমাদের সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র নির্মাণের কাজকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করে সবাইকে আহবান জানাতেন দিনরাত পরিশ্রম করার।
প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী কোটা সুবিধা মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের সন্তান, নাতি-নাতিন, পুতি পর্যন্ত পাবেন। আমার ছেলেকে আমি যখন বলি, তোমার দাদা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তখন আমার এক অসাধারণ অনুভূতি হয়। ছেলে যখন বড় হবে, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে যাবে, তখন কেউ যদি বলে, ‘তোমার দাদা আসল না নকল মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?’ তখন কী উত্তর দিবে আমার ছেলে?
দেশে এখন দুই ধরনের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং নাতি-নাতিন আছে। একদিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতিন, অন্যদিকে দুই নম্বর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতিন। আমি নিজেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে মনে করি। কিন্তু অন্য যে কেউ আমাকে দুইনম্বর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মনে করতে পারে এবং এরকম মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। আসলের সাথে নকল মিশে গেছে। আলাদা করার কোনো কার্যকরী পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না। নাতির পর পুতি পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধা বর্ধিত করার আগে একটা বিশুদ্ধ তালিকা তৈরি করতে হবে। না হলে আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সমাজে বিতর্ক তৈরি হবে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আসল মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারবর্গ সম্মান পাবেন না। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে যখন আমরা বিতর্ক করব, তখন সবচেয়ে খুশি হবে জামাত ও সমমনা অপশক্তি। সবচেয়ে দুঃখজনক হল, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে এই চরম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখে চলেছে মুক্তিযোদ্ধা নামে পরিচিত কিছু অসাধু লোক। এরা অমুক্তিযোদ্ধাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিচ্ছে। এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা আরও ভুয়া বানাবে। এভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিবে এরা।
তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন, কোটা আপনি কমান না কমান, আপনার ইচ্ছা। কিন্তু ভুয়াদের সনদ প্রদানের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিন। এই প্রক্রিয়া যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। এভাবে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকলে ৩০ শতাংশ কেন, আগামীতে ১০০ ভাগই কোটাধারীদের দিতে হতে পারে।
উপজাতি কোটা, নারী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটাসহ সমস্ত কোটায় সংস্কার আনা জরুরী হয়ে পড়েছে। উপজাতি (অবাঙালি বাংলাদেশী জাতিগোষ্ঠী) বলতে আমরা কাদেরকে বুঝি? ঘুরে ফিরে গুটিকয়েক নৃগোষ্ঠীই কোটা সুবিধা পাচ্ছে। সাঁওতাল বা চা বাগানের শ্রমিকরা কি পাচ্ছে? কয়েকটি গোষ্ঠীর রাজার মেয়ে/ছেলে কোটা পায়, কিন্তু একজন হতদরিদ্র হিন্দু বা মুসলমান বাঙালির ছেলে-মেয়ে পায়না কেন? বাঙালি হয়েছে বলে কি সে পাপ করেছে? এদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কৃষক বা শ্রমিকের জন্য কি কোনো কোটা আছে? শহরে বাস করা বড় লোক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি কোটা পাচ্ছে। কিন্তু দূর চরাঞ্চলে বাস করা গরীব মানুষগুলো কি কোন কোটা পাচ্ছে? এমন অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করে কোটা প্রথার সংস্কারকে যৌক্তিক বলে প্রমাণ করা যায়।
তাই কোটা সিস্টেমে যে সংস্কার শুরু হয়েছে, সেটি অব্যাহত রাখতে হবে। একদিকে শূন্যপদে মেধাবীদের নিয়োগ দিতে হবে, অন্যদিকে কোটায় নিত্য নতুন সংস্কার আনতে হবে। যেমন মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বিশুদ্ধ করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বিশুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত নাতি-নাতিনদের কোটা স্থগিত রাখা উচিত। উপজাতি কোটার সুবিধা সব গোষ্ঠী পাচ্ছে কি না সেটাও দেখতে হবে। পাহাড়ের স্থানীয় বাঙালি কিংবা চরাঞ্চলে বসবাস করা হতদরিদ্র বাঙালিকে কীভাবে কোটা সুবিধায় আনা যায় সেদিকেও নজর দিতে হবে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিয়েছে জাতিসংঘ। এই স্ট্যাটাসকে স্থায়ী করতে হলে কিছুদিন বর্তমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কোনো বিকল্প বাংলাদেশে নেই। প্রতি বছর বিসিএস পরীক্ষাসহ নানাবিধ চাকরির পরীক্ষা ও নিয়োগ দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার বলতে গেলে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। যে কাজ করে বেশি, তাঁর কাছে প্রত্যাশাও বেশী। মুক্তিযোদ্ধা, অমুক্তিযোদ্ধা সবাইকে নিয়েই আমাদের চলতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ।