আমিই ছিলাম ওর মন, প্রাণ।এক সময় আমিই ছিলাম ওর সব।  দীর্ঘ পাঁচ বছর ক্যাম্পাসে প্রেম করেছি। কথা ছিল দুজনে সংসার পাতবো। কিন্তু সংসার করতে গেলে তো অর্থের দরকার। আর অর্থের জন্য চাকরি দরকার। আমার যে সেটা নেই।

এ অবস্থায়ই   ওর কাছ থেকে চাপ আসতে থাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসার। একপর্যায়ে আত্মহত্যার হুমকি দেয় মনের মানুষটি। নানা চিন্তার পর ২০১৭ সালে বিয়ে করি আমরা। আমাদের সংসার ভালোই চলছি। আচমকা একদিন আমার কাছে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। এলোমেলো হয়ে যায় সব। মুহিবুর তার জীবনের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। প্রেমিকা রেহানা এখন অনেক দূরে। হয়তো সুখেই আছে। কিন্তু মুহিবুরের জীবনে গাঢ় অন্ধকার। রাজ্যের হতাশা নিয়ে দিন পার করছেন। মুহিবুর বলেন, রেহানা ভালোই থাকবে। কারণ তার চাকরি আছে। আর আমি এখনও বেকার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষার্থী মুহিবুর বলেন, একই বিভাগে পড়ার সুবাদে ২০১৩ সালে আমাদের দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। এর আগে রেহানা আরেক প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। সে সময় তার পাশে দাঁড়ানোয় সে প্রাণ ফিরে পায় আমাকে পেয়ে। এরপর থেকে তার কাছে আমি সব হয়ে গেলাম। বিয়ের পর বউয়ের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়ে যায়। এদিকে আমাকে কিছু কিছু টাকাও দিত রেহানা। আমি চাকরির জন্য পড়াশোনা করছি। চাকরি পাচ্ছি না। কেঁদে কেঁদে মুহিবুর বলেন, চাকরি পাইলে রেহানা এভাবে ছেড়ে চলে যেতো না আমাকে। এখন সে বিয়ে করার জন্য চাকরিজীবী ছেলে খুঁজছে।
তারুণ্যের বিয়ে সংকট নিয়ে মুহিবুরের চেয়ে জটিল ঝামেলায় বন্দি মানিকগঞ্জের রাবেয়া আক্তার। চাকরি পেয়েও তিনি বিয়ে করতে পারছেন না। কারণ, তার চেয়ে ভালো চাকরিজীবী পাত্র চাই। রাবেয়ার বয়স এখন ৩৪ বছর। সরকারি মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট পদে চাকরি করছেন। বেকার কোনো ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি না রাবেয়া। এমনকি তার কম স্কেলের বেতনের ছেলেকেও না। কাঙ্ক্ষিত চাকরিজীবী পাত্র না পাওয়ায় বিয়ে নিয়ে খুবই চিন্তিত রাবেয়া। মানিকগঞ্জের এই মেয়ে বলেন, দেশে উচ্চ শিক্ষিত ছেলেরা চাকরি না পাওয়ার কারণে এই সংকট হচ্ছে। তরুণ সমাজে বেকারত্ব না থাকলে কোনো ছেলেমেয়েকে বিয়ে নিয়ে এই সমস্যায় ভুগতে হতো না। রাবেয়া ছাড়াও ৩২ বছর বয়সী তার ছোট বোনও উপযুক্ত চাকরিজীবী না পাওয়ার কারণে বিয়ে করতে পারছেন না। ঠিক সময়ে চাকরি না পাওয়ার কারণে লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ মুহিবুর ও রাবেয়ার মতো নানা সংকটে দিন পার করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যলয়ের মতো উচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকে প্রতি বছর উচ্চশিক্ষা শেষ করে চাকরির বাজারে আসছেন বহু মেধাবী। ছুটছেন চাকরির খোঁজে। এভাবে অনেকে চাকরি পান। অনেকের চাকরির বয়স শেষ হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে বিয়ের বয়স। সংসারজীবন নিয়ে খুবই শঙ্কিত তারা। ক্রমেই তরুণরা হয়ে পড়ছেন বৈবাহিক জীবন নিয়ে হতাশাগ্রস্ত। এসব উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা জানান, চাকরি খুঁজবো নাকি বিয়ে করবো। চাকরি না পাইলে বিয়ে করা অসম্ভব।
গত বছরের এ সময়ে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের যুব-বেকারত্ব বিষয়ক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের যুব-সমাজের ৯ দশমিক ১ শতাংশ বেকার। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই হারে বেকার রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে প্রায় ২৬ লাখ বেকার রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৮ শতাংশ যুবক-যুবতী। যাদের বেশির ভাগ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। এসব তরুণ বেকারত্বের কারণে বৈবাহিক জীবনকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। বৈবাহিক জীবন মানুষের জীবনের অন্যতম অধ্যায় হলেও পুরোটাই নির্ভর করে স্বাবলম্বী হওয়ার ওপর। বেকারত্বের কারণে প্রাপ্তবয়স্ক তরুণরা পিছিয়ে যাচ্ছে বৈবাহিক জীবন থেকে। পা বাড়াচ্ছে হতাশার জগতে। তৈরি করছে অপরাধজগৎ।  এভাবে চলতে থাকলে হতাশা থেকে তৈরি হবে বিকৃত মানসিকতার শিক্ষিত তরুণসমাজ। সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে সমাজের।
এমনটাই মন্তব্য করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আয়েশা সুলতানা। এই মনোবিজ্ঞানী বলেন, মানুষের জীবনে বিবাহ হলো বায়োলজিক্যাল নিড বা জৈবিক চাহিদার অন্যতম একটি। এই অভাব যথা সময়ে স্বাভাবিক উপায়ে পূরণ করতে না পারলে তারা হতাশা থেকে আরো হতাশায় চলে যাবে। এক সময় তারা বিভিন্ন অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় উচ্চ শিক্ষিতদের মেধা যথাযথ প্রয়োগ না করার কারণে রাষ্ট্রের কোনো কাজে আসবে না তরুণ সমাজ। ক্রমেই তারা রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেন ঢাবির অধ্যাপক আয়েশা সুলতানা।
Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031