স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী শিক্ষকরা দীর্ঘদিন পর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমমর্যাদা পেলেন । নতুন মাদরাসা স্থাপন ও পুরাতন মাদরাসা নিবন্ধিত হতে হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। একইসঙ্গে নীতিমালা অনুযায়ী নতুন মাদরাসা স্থাপন, শিক্ষক নিয়োগ ও মাদরাসা পরিচালনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে।
গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ গঠিত ১১ সদস্য বিশিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সভায় এসব প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন শেষে তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হবে। সেখান থেকে অনুমোদন মিললেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
বিষয়টি স্বীকার করে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাদরাসা) ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক রওনক মাহমুদ বলেন, খসড়ায় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমান মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ, মাদরাসা পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়া নীতিমালায় ১৯টি দফা রয়েছে। দফাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মহানগর, পৌর ও শহর এলাকার মাদরাসায় কমপক্ষে ২০০ এবং মফস্বল এলাকায় ১৫০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীকে অংশগ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি মাদরাসায় একজন প্রধান শিক্ষক, চার জন সহকারী শিক্ষক ও একজন অফিস সহায়ক থাকবে। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে ফাজিল (স্নাতক)। একজন ক্বারী নিয়োগ দিতে হবে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) পাস। নারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমান নির্ধারণ করা হয়েছে। অফিস সহায়কের এসএসসি পাস হতে হবে। কারো শিক্ষা জীবনে তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য হবে না। মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদিত সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তক পাঠদান করতে হবে। সহশিক্ষা হিসেবে কেরাত, হামদ, নাত প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ক্রীড়া, খেলাধুলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, বৃক্ষরোপণ, কাব দল (স্কাউটিং), পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম করতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি শিক্ষক নিয়োগ দেবে। এই কমিটির সভাপতি হবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আর মেট্রোপলিটন এলাকায় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, সদস্য সচিব হবেন সংশ্লিষ্ট মাদরাসার প্রধান শিক্ষক। কমিটির অপর সদস্যরা হবেন- উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা বা থানা সদরের এমপিওভুক্ত একটি এবতেদায়ী মাদরাসার প্রধানের প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট মাদরাসার সভাপতি। মাদরাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপজেলা ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষক কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটির সভাপতি হবেন ইউএনও আর মেট্রোপলিটন এলাকায় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, সদস্য সচিব হবেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। কমিটির অপর সদস্যরা হবেন উপজেলা বা থানা সদরের এমপিওভুক্ত একটি এবতেদায়ী মাদরাসার প্রধান, স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের একজন প্রতিনিধি। নতুন মাদরাসা স্থাপনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় বলা হয়েছে, একটি মাদরাসা হতে অপর মাদরাসার দূরত্ব শহর এলাকায় এক কিলোমিটার। মফস্বল এলাকায় দুই কিলোমিটার। প্রাথমিক স্কুলের মতো মফস্বল এলাকার মাদরাসার শূন্য দশমিক ৩৩ একর, পৌর এলাকায় শূন্য দশমিক ২০ একর ও মেট্রোপলিটন এলাকায় শূন্য দশমিক ১০ একর জমি থাকতে হবে। মাদরাসার নামে রেজিস্ট্রি করা জমিতে অন্তত: টিনের বেড়াসহ টিনসেট ভবন বা পাকা ভবন থাকতে হবে। শিক্ষার্থী প্রতি এক বর্গ মিটার হিসেবে শ্রেণি কক্ষের আয়তন থাকতে হবে। প্রধান শিক্ষকের অফিস, শিক্ষক মিলনায়তসহ অন্তত পাঁচটি কক্ষ থাকতে হবে। মানসম্মত টয়লেট, শৌচাগার, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলে পর্যায়ক্রমে সংযোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠ ও পাঠাগার থাকতে হবে। নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, মাদরাসার স্থায়ী আমানত হিসেবে ব্যাংকে ২০ হাজার টাকা থাকতে হবে। নতুন মাদরাসা স্থাপনের ক্ষেত্রে মহান ব্যক্তির নামে নামকরণ করতে হলে সরকারি তহবিলে কোনো অর্থ জমা দিতে হবে না। তবে, কোনো ব্যক্তির নামে করতে হলে মাদরাসার তহবিলে পাঁচ লাখ টাকা জমা রাখতে হবে। নতুন মাদরাসা স্থাপনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সরজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদনের আলোকে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড অনুমোদন দেবে। অনুমোদনের পরে প্রাথমিক স্কুলের মতো ছয় সদস্য বিশিষ্ট ম্যানেজিং কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির সভাপতি হবেন উপজেলা ইবতেদায়ী শিক্ষা কমিটি মনোনীত ব্যক্তি। সদস্য সচিব হবেন প্রধান শিক্ষক। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হতে হলে অন্তত এক লাখ টাকা এবং দাতা সদস্য হতে হলে এককালীন ৫০ হাজার টাকা মাদরাসার তহবিলে জমা দিতে হবে। কমিটি গঠনের ৩০ দিনের মধ্যে উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডকে জানাতে হবে। কমিটির মেয়াদ হবে তিন বছর। প্রতি পাঁচ বছর পর পর পাঠদানের স্বীকৃতি অনুমোদন করাতে হবে। এজন্য মাদরাসা বোর্ডে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হবে।
নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি উদ্যোগে মাদরাসা স্থাপন করলে নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমান স্কেলে বেতন দিতে হবে। নীতিমালায় সরকারি নিবন্ধনের শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি অনুদানপ্রাপ্তদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। তাদের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সূত্র জানায়, গত বছরের অক্টোবর মাসে মাদরাসা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রওনক মাহমুদকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন কর হয়। কমিটিকে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে মাদরাসা স্থাপন, মঞ্জুরী, কমিটি গঠন, শিক্ষক নিয়োগ, পরিচালনা ও এমপিও ভুক্তিকরণসহ জাতীয় মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, আধুনিকায়ন ও কর্মমুখী করে গড়ে তুলতে একটি নীতিমালা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করে গতকাল নীতিমালা খসড়া চূড়ান্ত করেছে।