১২ মার্চ ঢাকা থেকে নেপালের ‍উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া ইউএস বাংলার একটি বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে গেলে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। এতে ৫১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ওই দুর্ঘটনায় যে কয়েকজন আহত হয়ে বেঁচে আছেন তাদের অনেকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

মর্মান্তিক ওই বিমান দুর্ঘটনার কারণ জানতে কয়েকদিন ধরেই চলছে নানা আলোচনা, অনুসন্ধান। গণমাধ্যমে আসছে নানান খবর। দুর্ঘটনার পেছনে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের দোষ, নাকি বৈমানিকের দোষ। নেপাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ক্যাপ্টেনের ঘাড়ে অনেকটা একতরফা দোষ চাপিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি এমন যে ক্যাপ্টেনের ভুলেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের বিমান চলাচল খাতে (এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি) ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এতে নিহত স্বজনেরা এখনো শোকে কাতর, শোকে মূহ্যমান পুরো জাতি। তবে এরই মধ্যে দুর্ঘটনা নিয়ে চলছে ময়নাতদন্ত।

প্রায় ১১ বছর ধরে বিমান চলাচল খাত নিয়ে সাংবাদিকতা করায় এই দুর্ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানী মন নিয়ে ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে দুর্ঘটনা সম্পর্কিত বিষয়ে পেয়েছি নতুন কিছু তথ্য। পাঠকদের কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরতেই আমার এই লেখা।

নেপালের দুর্ঘটনা নিয়ে দেশের বিমান চলাচল খাতের অগ্রপথিক রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স বিমান বাংলাদেশের কয়েকজন অভিজ্ঞ বৈমানিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। কোড অব কন্ডাক্টের কারণে বিষয়টি নিয়ে কোনো বৈমানিকই স্বনামে সংবাদ মাধ্যমে কিছু বলতে চাননি।

২৫ বছর আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনাকারী একজন বৈমানিকের মতে, উড়োজাহাজ উড্ডয়নের চেয়ে অবতরণেরই কাজটিই সবচেয়ে কঠিন। আর সেটি যদি হয় পাহাড়ে ঢাকা কোনো বিমানবন্দরে অবতরণ। তবে একজন দক্ষ বৈমানিক তার সঠিক প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে কঠিন কাজটিও সম্পন্ন করতে পারেন সহজেই। এটিই পেশাদারিত্বের উৎকর্ষতা।

আরেকজজন বৈমানিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, কাঠমান্ডুর বিমানবন্দরের অবতরণের আগ মুহূর্তে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ক্যাপ্টেনকে দেওয়া নির্দেশনায় বারবার পরিবর্তন এসেছে। এই নির্দেশনা ক্যাপ্টেনকে সঠিক পথ বাতলে দেওয়ার পরিবর্তে উল্টো বিভ্রান্ত করেছে। একজন বৈমানিক আকাশে অসহায় অবস্থায় থাকেন। ওই সময় যথাযথ নির্দেশনা পেলে ক্যাপ্টেন প্রতিকূল পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে পারেন।

বিমানের অন্য একজন জ্যেষ্ঠ বৈমানিক বলেন, ত্রিভুবন বিমাবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ক্যাপ্টেনকে বিভ্রান্ত করা হলেও বৈমানিক পেশাগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিস্থিতি থেকে উতরে যেতে পারতেন। কারণ এ ধরনের পরিস্থিতিতে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে যে ধরনের নির্দেশনাই দেওয়া হোক না কেন, উড়োজাহাজ অবতরণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুপ্রিম অথরিটি (সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ) ক্যাপ্টেনের হাতেই।

জ্যেষ্ঠ ওই বৈমানিক বলেন, এ ধরনের বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে উড়োজাহাজ পরিচালনার নিয়ম মেনে ক্যাপ্টেন ‘গো অ্যারাউন্ড’ এ যেতে পারতেন। অর্থাৎ ক্যাপ্টেন কন্ট্রোল টাওয়ারকে এটি বলার অর্থ তিনি বর্তমান অবস্থান থেকে উড়োজাহাজটিকে পুনরায় অবতরণ শুরুর স্থানে নিয়ে যাবেন। এতে করে উড়োজাহাজ আবারো প্রায় ২০ নটিক্যাল মাইল দূরে গিয়ে পুনরায় অবতরণের প্রস্তুতি নেবেন। বৈমানিক যেমন ‘গো অ্যারাউন্ড’ এ যেতে পারেন, তেমনি কন্ট্রোল টাওয়ার থেকেও এ ধরনের নির্দেশনা দিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি এড়ানো যেতো।

তার মতে, এটি ছাড়াও ‘রাডার ভেক্টর’ বলে একটি ম্যানুয়াল রয়েছে। প্রতিকূল আবহাওয়া অথবা কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে ক্যাপ্টেনের যে ভ্রান্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে-এ ক্ষেত্রে বৈমানিক এই ম্যানুয়াল অনুসরণ করতে পারতেন। নেপালের ফ্লাইটের ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন কন্ট্রোল টাওয়ারের কাছে ‘রাডার ভেক্টর’ চাইতে পারতেন। এটি দেওয়া হলে স্ক্রিনের মাধ্যমে ক্যাপ্টেনকে তার উড়োজাহাজের উচ্চতা, তার অবস্থান, রানওয়ের অবস্থাসহ নানা ধরনের তথ্য সঠিকভাবে প্রদান করে নিরাপদে অবতরণে সহায়তা করতে পারতো।

ওই বৈমানিক আরও বলেন, অপারেশনাল ম্যানুয়াল অনুযায়ী বৈমানিক এ ধরনের যেকোনো একটিকে বেছে নিয়ে উড়োজাহাজটিকে নিরাপদে অবতরণ করাতে পারতেন। এক্ষেত্রে কন্ট্রোল টাওয়ারেরও দায়িত্ব ছিল। এই দুটি ম্যানুয়াল দিয়ে তারাও ক্যাপ্টেনকে সাহায্য করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য একটি ম্যানুয়ালও আমরা ব্যবহার করতে পারলাম না। ঘটে গেল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও মর্মান্তিক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা।

ইশতিয়াক হুসাইন, এভিয়েশন সাংবাদিক

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031