ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে আইন প্রণয়ন করা হলেও তা কেবল কাগজে–কলমেই। দেশে ভোক্তাদের অধিকার এখনো সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে আগের মতোই বাজারে প্রতিনিয়ত প্রতারিত ও প্রবঞ্চিত হচ্ছেন ভোক্তারা। সু–সংগঠিত ভোক্তা আন্দোলন গড়ে না উঠায় এই প্রতারণা–প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে চট্টগ্রামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হলেও জনবলসহ নানা সংকটে কার্যত অচল হয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। মাত্র তিন কর্মকর্তা দিয়ে চলছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আর একজন কর্মকর্তা দিয়ে চলছে জেলা কার্যালয়। এছাড়া, পরিবহনসহ নেই আনুষঙ্গিক সুযোগ–সুবিধাও। ফলে জনবল ও পরিবহন সুবিধা সীমাবদ্ধতায় ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে তেমন ভূমিকাই রাখতে পারছেনা ভোক্তাদের জন্য গঠিত এই প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন– বাংলাদেশে ক্রেতা–ভোক্তাদের অধিকার নেই বললেই চলে। পকেটের টাকায় কিনে খেতে হচ্ছে মানহীন, নকল ও ভেজাল পণ্য। রাষ্ট্রায়ত্ত মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআই ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠান পণ্যমান নিয়ে কাজ করছে। বিশুদ্ধ খাদ্য আইনসহ এ সংক্রান্ত কয়েকটি আইন রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানসহ নানামুখী তৎপরতা চলমান রয়েছে। তারপরও থামছে না নকলবাজ–ভেজালবাজদের অপকর্ম ও দৌরাত্ম্য। শুধু খাদ্য ও ভোগ্য পণ্যই নয়, নকল ও ভেজালের তালিকায় বাদ যাচ্ছেনা ওষুধের মতো স্পর্শকাতর পণ্যও। ভোক্তার অধিকার তাই কাজীর গরুর মতোই, যা কিতাবে পাওয়া যায় কিন্তু বাস্তবে বা গোয়ালে নয়। এমন অভিমত ভোক্তা ও সংশ্লিষ্টদের।
আজ বৃহস্পতিবার (১৫ মার্চ) বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। আন্তর্জাতিক ভোক্তা আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে ভোক্তা আন্দোলনকে আরও গতিশীল করার প্রয়াসে প্রতিবছর এ দিবসটি বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়। ১১৫টিরও বেশি দেশের ২২২টি বেসরকারি সংগঠন ১৯৮৩ সাল থেকে দিবসটি পালন করে আসছে। ‘ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থাপনায় অধিকতর স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণ’ প্রতিপাদ্য নিয়েই এবার বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে দিবসটি। দিবসটি উদযাপনে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। আজ সকাল ৯টায় র্যালি ও দশটায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস মিলনায়তনে এ নিয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
জানা যায়– ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বের অনেক উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের ভোক্তা অধিকার আইন রয়েছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান ইত্যাদি দেশে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণের নির্দিষ্ট আইন অনেক আগেই প্রণীত হয়েছে। তবে, বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণীত হয় ২০০৯ সালে। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে আইনটি ঐ বছরের ৬ এপ্রিল থেকে কার্যকর করা হয়েছে।
এদিকে, আইনটি পাস হওয়ার পর ২০১০ সালে ঢাকায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরু হয়। চট্টগ্রামে এই অধিদপ্তরের কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে। মাত্র একজন উপসচিব পদমর্যাদার উপ–পরিচালক ও দুইজন অস্থায়ী কর্মচারী নিয়েই কাজ চালিয়ে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে, প্রতিষ্ঠার ২ বছর পর ২০১৩ সালে আরেকজন সহকারি পরিচালককে চট্টগ্রামে যুক্ত করা হয়। ২০১৫ সালে যুক্ত করা হয় আরো একজন। এখন তিনজন কর্মকর্তা ও দুইজন অস্থায়ী কর্মচারী দিয়েই চলছে চট্টগ্রামে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটি। অবশ্য, একজন সহকারি পরিচালক দিয়ে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে চালু করা হয়েছে জেলা কার্যালয়ও। তবে তীব্র জনবল সংকটের পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানে নেই পরিবহনসহ অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা। যার কারণে অধিকার সংরক্ষণে আইন পাস ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা হলেও কার্যত তেমন সুফল পাচ্ছেনা সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামের ভোক্তারা।
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও জনবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে কাঙিক্ষত সংখ্যক অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়না বলে দাবি ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক মোহাম্মদ হাসানুজ্জামানের। তিনি বলেন– আমাদের পরিবহন সুবিধা নেই। জনবল সংকটও প্রকট। তাই জনবল সংকট ও নানা সীমাবদ্ধতায় ইচ্ছে থাকলেও আমাদের পক্ষে ঘন ঘন অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়না। এরপরও সীমিত জনবল ও পরিবহনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবের মাঝেই আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি। মাসে বেশ কয়বার অভিযান পরিচালনা করে থাকি। আরো বেশি করা গেলে সাধারণ ভোক্তারা হয়তো আরো বেশি উপকৃত হতো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে চট্টগ্রামের বন্দরটিলা এলাকায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যা শহরের এক পার্শ্বে। যাতায়াত ঝামেলার কারণেও মানুষ সেদিকে যেতে চায়না। অথচ, শহরের কেন্দ্রেস্থলে অধিদপ্তরটি করা হলে এমন হতোনা। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটিতে জনবল–পরিবহনসহ সব ধরণের সুযোগ–সুবিধার অভাব রয়েছে। যার কারণে তাঁরা তেমন কাজই করতে পারছেনা। আর সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় ভোক্তারা এখনো প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হয়ে আসছেন। এই প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে হলে ভোক্তাদের সচেতন হওয়া জরুরি বলেও অভিমত এস এম নাজের হোসাইনের।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের মূল উদ্দেশ্য : ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্য প্রতিরোধ, ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনজনিত অভিযোগ নিষ্পত্তি, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার ব্যবস্থা, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, পণ্য বা সেবা ক্রয়ে প্রতারণা রোধ, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি। আইনটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, প্রত্যেক জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
এ আইনে ভোক্তা কে : বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত যিনি, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন, আংশিক মূল্য পরিশোধ করে বা আংশিক বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন, কিস্তিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন।
ভোক্তা অধিকার কি কি: নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়া, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভ, লিখিত অভিযোগ দায়ের। পণ্যের উপাদান, মেয়াদোর্ত্তীণের তারিখ, সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য ইত্যাদি জানা, নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্য প্রদান না করা, পণ্য যথাযথ ওজন বা পরিমাপে পাওয়া, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথযথভাবে পাওয়া।
ভোক্তার যেসব দায়িত্ব রয়েছে : ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে জানা, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের সুফল সম্পর্কে জানা, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্যের কুফল সম্পর্কে জানা, যাচাই–বাছাই করে যথাযথ পণ্য বা সেবা সঠিক মূল্যে কেনা, ভোক্তা অধিকার বাস্তবায়নে সংগঠিত ও সোচ্চার হওয়া।
বিক্রেতা কে : কোনো পণ্যের উৎপাদনকারী বা প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা।
ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্য বা অপরাধ কি কি : নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্য কোনো পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, জেনেশুনে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক দ্রব্য মিশ্রিত কোনো খাদ্য পণ্য বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা, ওজনে কারচুপি করা, বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি করা, পরিমাপে কারচুপি করা, দৈর্ঘ্য পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা, কোনো নকল পণ্য বা ওষুধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো কার্য করা যাতে সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ করা, অবহেলা, দায়িত্বহীনতা দ্বারা সেবা গ্রহীতার অর্থ বা স্বাস্থ্যহানি ঘটানো, কোনো পণ্য মোড়ক আবদ্ধভাবে বিক্রয় করার এবং মোড়কের গায়ে পণ্যের উপাদান, সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করা, আইনানুগ বাধ্যবাধকতা অমান্য করে দোকান বা প্রতিষ্ঠানে মূল্য তালিকা সংরক্ষণ না করা এবং সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে ঐ তালিকা ঝুলিয়ে প্রদর্শন না করা।
কারা অভিযোগ করতে পারেন : কোনো ভোক্তা, একই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক ভোক্তা, কোনো আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো ভোক্তা সংস্থা, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বা তার পক্ষে অভিযোগ দায়েরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা, সরকার বা সরকার কর্তৃক মতাপ্রাপ্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী।
যেখানে অভিযোগ দায়ের করা যাবে: প্রত্যেক জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) বরাবর অভিযোগ জানানোর সুযোগ রয়েছে। এছাড়া জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরেও অভিযোগ জানাতে পারেন প্রতারিত ও সংক্ষুব্ধ ভোক্তারা।
অভিযোগ দায়েরের সময়সীমা : কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করতে হবে।