বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদে।কর্ণফুলী হালদা ও শঙ্খ নদী দখল ও দূষণরোধে সচেতনতা ও কঠিন আইন প্রয়োগের পাশাপাশি হালদাকে জাতীয় নদী ঘোষণা করতে হবে। এছাড়া নদীর বিপর্যয়রোধে ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস উপলক্ষে দৈনিক পূর্বকোণ আয়োজিত ‘বিপর্যস্ত কর্ণফুলী, হালদা ও শঙ্খ নদী রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকগণ একথা বলেন।
বক্তারা আরো বলেন, শহরের বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণ হচ্ছে হালদা। বামনশাহী খালটি অনন্যা আবাসিকে প্রতিবন্ধকতায় পড়ার কারণে অক্সিজেন ও কূলগাঁও এলাকার শিল্পকারখানার বর্জ্য সরাসরি কুয়াইশ ও খন্দকিয়া খাল হয়ে হালদা নদীতে গিয়ে পড়ছে। এ মুহূর্তে বামনশাহী খালের প্রতিবন্ধকতা দূর এবং পুনঃসংস্কার না করলে হালদাকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
গোলটেবিল বৈঠকে এই তিনটি নদীকে চট্টগ্রামের প্রাণ হিসাবে অভিহিত করে বৈঠকে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব নেয়া হয়েছে। পূর্বকোণ কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে গতকাল মঙ্গলবার সকালে গোলটেবিল বৈঠকে সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন প্রফেসর এবিএম আবু নোমান। এতে আলোচক ছিলেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, সাবেক মুখ্য সচিব ও পিকেএসএফ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল করিম, ইস্ট–ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও কর্ণফুলী প্রকল্প–২ এর প্রজেক্ট ডিরেক্টর এয়াকুব মোহাম্মদ সিরাজুদৌল্লাহ, চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসার মোহাম্মদ মুমিনুল হক, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পওর –৩) এর নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন কুমার বড়–য়া ও ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) এর নির্বাহী পরিচালক জহিরুল আলম। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন দৈনিক পূর্বকোণ চেয়ারম্যান ও প্রকাশক জসিম উদ্দিন চৌধুরী। ধন্যবাদ সূচক বক্তব্য রাখেন দৈনিক পূর্বকোণ সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক পূর্বকোণের পরিচালক জাসির চৌধুরী, তকির চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক স্বপন দত্ত, বার্তা সম্পাদক কলিম সরওয়ার, চিফ রিপোর্টার নওশের আলী খান, সিনিয়র রিপোর্টার মোহাম্মদ আলী, সাইফুল আলম প্রমুখ।
সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, কর্ণফুলী, হালদা ও শঙ্খ চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। নদীগুলো দখল–দূষণ হচ্ছে, মা মাছের প্রজনন পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে, তা থেকে রক্ষা পাওয়াটা সময়ের ব্যাপার বলে মনে করি। কর্ণফুলী, হালদা নদী একদিনে দখল–দূষণ হয়নি। যুগের পর যুগ চলে এসেছে। আগে পদক্ষেপ নিলে এত দূর আসতো না। এ ক্ষেত্রে জনমত তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, হালদাকে জাতীয় নদী ঘোষণার যৌক্তিকতা আছে। এখন ব্রিজ নির্মাণ করা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ব্রিজের কারণে নদীতে পলি জমে যায়। ব্রিজ দেয়ার আগে চিন্তা–ভাবনা করতে হবে। পানি চলাচল যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেটা নিশ্চিত হয়ে ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে।
সাবেক মুখ্য সচিব মো.আবদুল করিম বলেন, টেমসের দু’পাড়ে লন্ডন, কিন্তু টেমস নদীর পানি পরিষ্কার। হার্ডসনের দু’পাড়ে নিউইয়র্ক, কিন্তু পানি পরিষ্কার। এমনকি দজলা ফোরাত যেটা ইরাকে, তার পানিও পরিষ্কার। ম্যাকং নদীর পানি হালদা থেকেও অনেক পরিষ্কার। আমরা দুঃখিত এখানে আমরা হালদাকে পরিষ্কার রাখতে পারিনি। হালদা অচিরেই বুড়িগঙ্গায় পরিণত হবে। বুড়িগঙ্গা পাড়ে যদি একবার আপনি খালি গায়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে পরবর্তীতে আপনার চামড়া খসে পড়বে। এ রকম দূষণ হালদায়ও হবে। বাংলাদেশে একটি নদী দূষণ কমিশন আছে। এর কার্যক্রমটা যাতে অন্তত চট্টগ্রামে হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর কর্ণফুলী পাড়ের কারখানাগুলোতে ইটিপি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
ইস্ট–ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, আমি দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। দূষণ আর দখল। দূষণ যারা করছেন তারা হামেশাই করবেন। বর্তমানে যে সিস্টেম আছে, সে নিয়মে তাদের রোধ করতে পারিনি। এটার জন্যই আরো ভিন্ন রকম কিছু চিন্তা করতে হবে। আর দখল যারা করছেন তারা মেশিন দিয়ে, কেটে কিংবা নানাভাবে দখল করছেন। নদী সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এটির ব্যাপারে আরো পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
সিডিএ’র চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, নদী দূষণ ও দখলমুক্ত করতে দূষণের উৎপত্তিস্থলগুলো চিহ্নিত করে সেটা রোধ করতে হবে। সিডিএর অনন্যা প্রকল্পের কারণে খালের গতিপথ বন্ধ হয়েছে। আমি আসার আগে অনন্যা প্রকল্পটা করা হয়েছে। অনন্যার কারণে খাল বন্ধ হয়নি। এটা বন্ধ হয়েছে কতিপয় রাজনৈতিক কারণে।
দৈনিক পূর্বকোণ চেয়ারম্যান ও প্রকাশক জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি নদী কর্ণফুলী, হালদা ও শঙ্খ। এর মধ্যে হালদা নদী বাংলাদেশের অন্য দশটি নদীর মত হলেও এর বৈশিষ্ট্য কিছুটা ভিন্ন। নদীতে স্মরণাতীত কাল থেকে রুই জাতীয় মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) ডিম ছেড়ে আসছে। এ অঞ্চলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ কর্ণফুলী নদী শুধু চট্টগ্রাম নয়, গোটা দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু দূষণ–দখলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ নদী। সারাবছর ভাঙে শঙ্খ। আশা করি আজকের আলোচনা থেকে একটা ভালো সমাধান পাবো।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, শহরের বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণ হচ্ছে হালদা। বিশেষ করে অক্সিজেন ও কূলগাঁও এলাকার শিল্পকারখানার বর্জ্য সরাসরি এ নদীতে পড়ছে। আগে এসব এলাকার বর্জ্য বামনশাহী খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে যেতো। কিন্তু অনন্যা আবাসিক হওয়ার পর বামনশাহী খালটি প্রতিবন্ধকতায় পড়ে। আবাসিকের পশ্চিম পাশের ড্রেনের সাথে বামনশাহী খালটি সংযুক্ত করে দেয় সিডিএ। এতে বামনশাহী খালের বর্জ্য আবাসিকের ড্রেনের মাধ্যমে গিয়ে পড়ছে কুয়াইশ খালে। সেখান থেকে এসব বর্জ্য কুয়াইশ খাল ও খন্দকিয়া খাল হয়ে হালদা নদীতে গিয়ে পড়ছে। অপরদিকে প্রতিবন্ধকতার কারণে বামনশাহীর খালে বিরাট অংশ ভরাট হয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে বামনশাহী খালটি পুনঃসংস্কার করে অনন্যা আবাসিকের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। না হয় খন্দকিয়া খাল হয়ে হালদায় বর্জ্য যেতে থাকবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুষদ ডিন প্রফেসর এ বি এম আবু নোমান বলেন, দখল–দূষণ বন্ধ না হলে কর্ণফুলী, হালদা ও শঙ্খ নদী রক্ষা করা যাবে না। সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন, কঠোর আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নদী রক্ষা করতে হবে। যথাযথ উদ্যোগ নেয়া না হলে নদীগুলো ভাঙনরোধ করা যাবে না। এছাড়া দূষণ প্রতিরোধ করা না গেলে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা অচিরেই বুড়িগঙ্গার মতো ভাগ্যবরণ করবে। এসব নদীর সমস্যা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। তার জন্য সমন্বিত প্রয়াস বা উদ্যোগ নিতে হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে এয়াকুব মোহাম্মদ সিরাজুদৌল্লাহ বলেন, কর্ণফুলী নদীতে টোটাল যে ফ্লো আছে কর্ণফুলী প্রকল্পের মাধ্যমে তার পয়েন্ট জিরো সেভেন পাসেন্ট পানি নিচ্ছি। কর্ণফূলী ও হালদাতে আমাদের জন্য কোনো দূষণ হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসার মোহাম্মদ মুমিনুল হক বলেন, চট্টগ্রামের যে তিনটি নদী, তার মধ্যে হালদা নদী হচ্ছে অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নদী। হালদা নদীকে বাঁচানোর জন্য সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। অন্যথায় বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষার মতো করুণ পরিস্থিতির শিকার না হলেও এর কাছাকাছি চলে যাবে। সিটি মেয়র, সিডিএ চেয়ারম্যান, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে হালদা নদীকে বাঁচাতে পারলে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি রক্ষা করতে পারব।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন কুমার বড়ুয়া বলেন, কর্ণফুলী, হালদা ও সাঙ্গু– এই তিনটি নদী চট্টগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ড জন্মলগ্ন থেকে এই তিনটা নদী নিয়ে বিভিন্নভাবে কাজ করে আসছে। তবে দখলরোধ আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে অনেকটা পড়ে না। ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করে আসছে। বর্তমানেও কাজ করছে।
আইডিএফ এর নির্বাহী পরিচালক জহিরুল আলম বলেন, সরকার, স্থানীয় লোকজন, শেয়ার হোল্ডারদের সাথে সমন্বয় করে হালদা পুনঃরক্ষা করার লক্ষ্যে আইডিএফ কাজ করছে।
ধন্যবাদ সূচক বক্তব্যে দৈনিক পূর্বকোণ সম্পাদক ডা. রমিজ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সকল আলোচককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, পূর্বকোণ শুরু থেকে নদী নিয়ে লেখালেখি করছে। ২০১৫ সালে পূর্বকোণের একটি টিম কর্ণফুলীর উৎপত্তিস্থল দেখার জন্য ভারতের মিজোরামে গিয়েছিলেন। তাঁরা ঘুরে এসে সচিত্র রিপোর্টিং করে। বাংলাদেশের কোন পত্রিকা এভাবে কর্ণফুলীর উৎপত্তিস্থল থেকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে কাজ করেনি।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |