দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুকে চতুর্থ দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে । প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকায় গতকাল দুদকের সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কমিশনের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে তাকে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোন কথা না বলে নো কমেন্টস বলে চলে যান। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে হয়রানী করা হচ্ছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে বাচ্চু বলেন, সেটা দুদককে জিজ্ঞাসা করেন। সূত্র জানিয়েছে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে বাচ্চু অসুস্থ হয়ে পড়েন।
তবে বাচ্চু বলেছেন- জিজ্ঞাসাবাদে নয়, তিনি আগে থেকেই অসুস্থ।
এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তিনি দুদকের কাছে এক মাস সময় চান। দুদক সেই আবেদন গ্রহণ করেনি। কিন্তু ৪ঠা ডিসেম্বর দুদকের তলবে প্রথম বারের মত দুদকের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেদিন দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে। এখনও তা প্রমাণিত নয়। এ ছাড়া দুদক কর্মকর্তারা যা জানতে চেয়েছেন, তার উত্তর তিনি দিয়েছেন। আবারও ডাকা হলে তিনি সহযোগিতা করবেন। তিনি আরো বলেন, নিজেকে আমি দোষী মনে করি না। তদন্ত চলা অবস্থায় দুদক যে অভিযোগগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে সেগুলোর উত্তর দিয়েছি। প্রয়োজনবোধে দুদককে আরো সহযোগিতা করবো। তার একদিন পরে ৬ই ডিসেম্বর আবার তিনি দুদক কার্যালয়ে হাজির হোন। সকাল ১০টা থেকে বিকাল প্রায় ৫টা পর্যন্ত দুদকের সেগুন বাগিচার প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের পরিচালক জায়েদ হোসেন খান ও সৈয়দ ইকবালের নেত্বতে ৯ সদস্যর একটি টিম বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এসময় তাকে রাষ্টয়াত্ত্ব বেসিক ব্যাংক থেকে নিয়ম বহির্ভুতভাবে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের জন্য রাজধানীর তিনটি থানায় করা ৫৬টি মামলায় আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে দুপুর ২টার দিকে তিনি শারিরীকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দুদকের নিজস্ব চিকিৎসক তাৎক্ষনিক চিকিৎসা দেয়ার পর পুনরায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিকাল ৫টার দিকে দুদক কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোন কথা বলেননি। সাংবাদিকরা এসময় নানা প্রশ্ন করলে তিনি মুখ খোলেননি। তখন তাকে অনেকটাই বিমর্ষ দেখা যায়। মাথা নিচু করে বির বির করে কি বিপদে পড়লাম বলে তিনি ব্যক্তিগত গাড়িতে উঠে চলে যান।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে গত ২২শে নভেম্বর থেকে চলা জিজ্ঞাসাবাদে বাচ্চুর দুই মেয়াদে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক ১০ সদস্যকেও ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। তারা হলেন, ব্যাংকের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক কামরুন নাহার আহমেদ, অধ্যাপক কাজী আকতার হোসাইন, সাখাওয়াত হোসেন, ফখরুল ইসলাম, একেএম কামরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, শ্যাম সুন্দর শিকদার, একেএম রেজাউর রহমান, আনোয়ারুল ইসলাম ও আনিস আহমেদ। তাদেরকে আলাদা চিঠি দিয়ে দুদকে তলব করা হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় এখন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পর্যায়ক্রমে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলার চার্জশিট আদালতে পেশ করা হবে।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রয়াত্ব বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরনে অনিয়মের অভিযোগ উঠে। ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া, জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দানসহ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বিধি বহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে। এরপর দুদক বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে। প্রায় চার বছর অনুসন্ধান শেষে এই অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় গত বছর রাজধানীর তিনটি থানায় ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। আসামিদের মধ্যে ২৬ জন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বাকিরা ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক জরিপ প্রতিষ্ঠানে যুক্ত। তবে আসামির তালিকায় বাচ্চু বা ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের কেউ না থাকায় দুদকের ওই তদন্ত নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এ বিষয়ে দুদকের বক্তব্য ছিল, ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা তারা পায়নি। তাই তার নাম আসামির তালিকায় রাখা হয়নি। অথচ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুই মেয়াদে ছয় বছর রাষ্ট্রায়ত্ত ওই ব্যাকংটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। আর ওই সময়টাই এ বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। কিন্তু চলতি বছরের আগষ্ট মাসে এক মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের আসামী না করায় উম্মা প্রকাশ করেন। তারপর থেকেই দুদক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।