দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) ভাষা আন্দোলন জোরদার হলো। ধাপে ধাপে এই আন্দোলন নতুন উৎকর্ষ পেয়েছিল। ওই সময়কার সংবাদপত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদপত্রগুলোর অবস্থান কী ছিল তাও বোঝা যায় সহজে। কিছু পত্রিকা ছিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের আজ্ঞাবহ। তারা প্রথমে এই আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ায়নি। আবার কিছু পত্রিকা আন্দোলনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্তে অবস্থান বদলেছে। এর পেছনে বাংলা ভাষার প্রেম নাকি পাঠক পছন্দকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। কারণ, এই পত্রিকাগুলো আবারও সুযোগ বুঝে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় খুব বেশি পত্রিকা এই অঞ্চলে ছিল না। এর মধ্যে চারটি পত্রিকার অবস্থান বেশ পোক্ত ছিল। তাদের প্রভাবও ছিল বেশ। বাংলায় দৈনিক সংবাদ, আজাদ। ইংরেজিতে মনিং নিউজ ও পাকিস্তান অবজারভার। কিছু প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকার কথা জানা যায়। এগুলোর বেশ কাটতি ছিল।
দৈনিক সংবাদ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল
পত্রিকাটিকে পাকিস্তান মুসলিম লীগের মুখপত্র বলা হতো। সংবাদে ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি বিষয়ক খবরগুলো ছাপা হয়নি। পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। বায়ান্ন সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার একটি অংশ সংবাদ কার্যালয়ে আক্রমণ করে। পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়। মুহুর্মুহু গুলিতে ছাত্ররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। সংবাদের এই অবস্থান অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। খোদ সংবাদের দুই প্রতিষ্ঠাতা সহকারী সম্পাদক ফজলে লোহানী এবং ড. মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম পদত্যাগ করেন।
দৈনিক আজাদ: কখনো পক্ষে, কখনো বিপক্ষে
পূর্ব বাংলায় প্রচার সংখ্যায় এগিয়ে ছিল দৈনিক আজাদ। কিন্তু শুরুর দিকে পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপেনি। তবে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের গুলি করা হলে সন্ধ্যায় আজাদ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বের করা হয়। মূল শিরোনাম ছিল ‘ছাত্রদের তাজা খুনে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত।’ এতদিন যারা আন্দোলনকে মেনে নিতে পারছিল না, খবর ছাপাতেও দ্বিধা ছিল সেই তারা মুহূর্তে অবস্থান বদলে ফেললো। পক্ষে চলে এলো। এটি কি পত্রিকাটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক মওলানা আকরম খাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি, নাকি মুসলিম লীগের ভেতরকার দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ তা জানা যায়নি। তবে তৎকালীন নুরুল আমীন সরকার দৈনিক আজাদের এই বিশেষ সংখ্যা বেআইনি ঘোষণা করেছিল।
এখানেই শেষ নয়, পত্রিকাটির বেতনভুক্ত সম্পাদক ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দিন। তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনিও পদত্যাগ করেন। এই খবরটিও ফলাও করে ছেপেছিল দৈনিক আজাদ। ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিলÑ ‘পুলিশ ও সৈন্যদের গুলিতে ৪ জন নিহত: ৭ ঘণ্টার জন্য কারফিউ।’ ‘শুক্রবার শহরের অবস্থার আরও অবনতি: সরকার কর্তৃক সামরিক বাহিনী তলব।’ ‘পুলিশের জুলুমের প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের পরিষদ সদস্য পদে ইস্তফা।’ ‘শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে শহরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন।’
চারদিনের মাথায় বোল পাল্টায় দৈনিক আজাদ পত্রিকা। এ সময় নারায়ণগঞ্জে জনৈক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হলে ‘মর্নিং নিউজ’ এবং ‘সংবাদ’ পত্রিকার পাশাপাশি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাও ভাষা আন্দোলনকারীদের কটাক্ষ করে। এদের মধ্যে ‘ভারতের অনুচরদের অনুপ্রবেশ হয়েছে’ বলেও অভিযোগ তোলা হয়।
দৈনিক স্বাধীনতা: কলকাতার দুটো পত্রিকা ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘আনন্দবাজার’-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয় গিয়েছিল পুরোপুরি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে। তারা এ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা উসুল করে। ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার সম্পাদকীয়র শিরোনাম করা হয়Ñ ‘পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলন ও হিন্দুদের অবস্থা।’ ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের পর থেকে মুসলিম লীগ সরকার ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বলতে গেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিল। কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন কলকাতার এই দুই পত্রিকার সম্পাদকীয় থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার পর সরকার সুপরিকল্পিভাবে আরও কঠোর অবস্থান নেয়।
ইংরেজি পত্রিকাগুলোর অবস্থান: ইংরেজি পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘পাকিস্তান অবজারভার’ তখন বন্ধ ছিল। কিন্তু ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার অবস্থান ছিল একেবারেই নগ্ন। তারা শুরু থেকেই বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং বাঙালি কৃষ্টি ও লোকাচারকে ‘হিন্দুয়ানী’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের তীব্র বিরোধিতা করাই ছিল পত্রিকাটির অন্যতম নীতি। তারা আগাগোড়াই ছিল বাঙালি বিদ্বেষী। বায়ান্নর ২২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ভিক্টোরিয়া পার্কের গলির মধ্যে পত্রিকাটির প্রেসে (জুবিলি প্রেস) আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
তবে এর বাইরে তিনটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ভাষা আন্দোলনে জোর সমর্থন দিয়েছিল। প্রথমটি হচ্ছেÑ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। আবদুল গাফুরের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’। তমুদ্দুন মজলিশের সমর্থক এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো আজিমপুরের ‘আমাদের প্রেস’ থেকে।
তৃতীয়টি হচ্ছে সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘নওবেলাল’। সম্পাদক ছিলেন ওই সময়কার যুবলীগ সভাপতি মাহমুদ আলী। তিনি পরে গণতন্ত্রী দলের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহচর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যও সোচ্চার ছিলেন লেখনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষে তারা তখন ‘মাসিক অগত্যা’য় নিয়মিত লিখতেন।
এছাড়া ঢাকা থেকে প্রকাশিত খন্দকার আবদুল কাদের সম্পাদিত ‘নতুন দিন’, ফেনী থেকে খাজা আহমদের সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক সংগ্রাম’ এবং চট্টগ্রাম থেকে প্রগতিশীল গোষ্ঠীর প্রকাশিত ‘সীমান্ত’ পত্রিকাটি ছিল ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।