‘প্রশ্নপত্র ফাঁস রোগে আক্রান্ত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন ’। বোর্ড পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা– যেই পরীক্ষাই হোক না কেন, পাবলিক পরীক্ষা হলেই এখন অনেকে আগে থেকে প্রশ্ন পেয়ে যাচ্ছে। সেটা কখনো পুরো প্রশ্নপত্র, কখনো বা আংশিক। কখনো বা সরাসরি, কখনো বা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার বা ভাইবারে। প্রশ্ন পৌঁছে যাচ্ছে পরীক্ষার্থীদের হাতে হাতে। পরীক্ষার আগের রাতে বা সকালে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা চড়া মূল্যে কিনে নিচ্ছেন সেই প্রশ্নপত্র। প্রশ্নপত্র ফাঁস বিষয়টি হয়ে উঠেছে এক বড় ব্যবসা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এটি হয়ে উঠেছে শিক্ষা ব্যবস্থার অনিবার্য গলার কাঁটা। হয়ে উঠেছে এক দুরারোগ্য ‘গোদফোড়া’।
গতকাল দৈনিক আজাদীসহ বেশ কয়েকটি দৈনিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রথম দিন বাংলা প্রথম পত্র দিয়ে শুরুর পর গত সোমবার পর্যন্ত তিনটি পরীক্ষায় (দুটি বিষয়ের তিনটি পত্র) অংশ নিয়েছে নিয়মিত পরীক্ষার্থীরা। সোমবার অনুষ্ঠিত হয় ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষা। অনুষ্ঠিত হওয়া এ পর্যন্ত তিনটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই পরীক্ষার আগে ফাঁসের খবর বেরিয়েছে গণমাধ্যমে। ফেসবুকে অগ্রিম ঘোষণা দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমুসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব প্রশ্ন ফাঁসের খবর মিলছে। তবে প্রশ্ন ফাঁসের নামে বিভ্রান্তির ঘটনাও ঘটছে কোথাও কোথাও। এ নিয়ে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরীক্ষার্থীরাই। বিভ্রান্তির পাশাপাশি হতাশা ও দুশ্চিন্তা নিয়েই পরীক্ষায় অংশ নিতে হচ্ছে লাখো শিক্ষার্থীকে। ঘোষণা দিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের পেছনে ছুটবে নাকি নিজের প্রস্তুতিতে থাকবে, এ পর্যন্ত দেয়া পরীক্ষাগুলো ঠিক থাকবে নাকি নতুন করে আবার দিতে হবে–ভেবে দিশেহারা পরীক্ষার্থীরা। সারা বছর প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষার সময় এ অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগে অস্থির পরীক্ষার্থীরা।’
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, প্রশ্ন ফাঁসের মতো একটি দুষ্কর্ম দীর্ঘদিন ধরে সংঘটিত হলেও বক্তৃতা–বিবৃতি ছাড়া কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে আর কোনো দায় আছে বলে মনে হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, রীতিমতো সিন্ডিকেট গঠন করে দুষ্কৃতকারীরা একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটাচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় প্রায় ক্ষেত্রেই ধরা না পড়ার বন্দোবস্তও পাকা করে রাখে সংঘবদ্ধ চক্র। বস্তুত প্রশাসনের একটি অসাধু চক্রকে ‘ম্যানেজ’ করে কিংবা ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনকে সম্পৃক্ত করে এসব অপকর্ম করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে সংসদে শিক্ষামন্ত্রীর বরখাস্ত দাবি করেছেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু। বস্তুত প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিয়ম মেনে চলতে ও আইন প্রতিপালনে আন্তরিক না হয়, তাহলে কোনোদিনও দেশ থেকে এই নৈরাজ্য দূর হবে না।
ধারণা করা হচ্ছে যে, পরীক্ষা শুরুর আগে কেন্দ্র থেকে বা উপজেলা থেকে কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র নেওয়ার দায়িত্বে থাকা কোনো অসাধু শিক্ষক বা ব্যক্তি প্রশ্নপত্রের সিলগালা প্যাকেট খুলে মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে ছবি তুলে তা বাইরে পাঠিয়েছে। সেখান থেকে সামাজিক মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে তা বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজে ছড়িয়ে পড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁকারীরা সংঘবদ্ধ ও সুচতুর। তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নিত্যনতুন অপকৌশল অবলম্বন করছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা এখন আমাদের অনিবার্য নিয়তি হয়ে পড়েছে। একটা সময় ছিল, নকল ছাড়া পাবলিক পরীক্ষা ছিল অকল্পনীয়। বর্তমান প্রশাসন দেখিয়েছেন, নকলমুক্ত পরীক্ষা চাইলে এ দেশেও সম্ভব। নকলের স্থানটা এখন প্রশ্নপত্র ফাসের দখলে। তাই সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা পরীক্ষাগুলো প্রশ্নপত্র ফাঁসমুক্ত করবেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের হাত থেকে উদ্ধার করবেন জাতিকে। দেশের শিক্ষাকে কলঙ্কমুক্ত করবেন। যদি প্রশ্ন ফাঁসকারীদের গলায় সর্বোচ্চ দণ্ডের ফাঁস পরানো যায়, তবেই সার্থক হবে প্রশাসন তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’–এর ঘটনাকে জাতীয় সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেক শিক্ষাবিদ। তাঁরা এই সংকট কাটাতে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়ার তাগিদও দিয়েছেন। প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিতে পারলে সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এই ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, প্রয়োজনে বেশ কঠোর হতে হবে। অপরাধী চক্রকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কৌশলী হতে হবে।