সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকারীর উদ্দেশ্য টাকা বানানো নয় ।
দৃশ্যত আর্থিক কোনো লাভ ছাড়াই ফাঁস করা হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন। এ জন্য প্রশ্ন উঠেছে, কেন তবে প্রশ্ন ফাঁস।
ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে বিনা পয়সায় প্রশ্ন দেয়া হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে টাকা চাওয়া হলেও তার পরিমাণ এতই নগণ্য যে এতে কারও ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
আবার ১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষা শুরু হওয়া ২৪ মিনিট আগে ফেসবুক পেজে প্রশ্ন ছড়িয়ে দেয়া হলেও তার আগেই পরীক্ষার হলে ঢুকতে হয়েছে পরীক্ষার্থীদের। কারণ এবার ৩০ মিনিট আগে হলে ঢোকা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।
আবার পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নেয়া নিষিদ্ধ থাকায় এই প্রশ্ন কয়জন শিক্ষার্থী পেয়েছে সেটাও প্রশ্নের অতীত নয়। তারপরও প্রশ্ন দেয়া হবে বলে ফেসবুকে রীতিমত বিজ্ঞাপন চলছে।
আবার পরীক্ষার দিন যে প্রশ্ন ফেসবুকে গেছে, সেটি মোবাইল ফোনে তোলা ছবি-সেটিও স্পষ্ট। অর্থাৎ পরীক্ষার দিন হলে প্রশ্ন পাঠানোর সময় অথবা হলে প্রশ্ন যাওয়ার পর কেউ না কেউ সেটির ছবি তুলে পাঠিয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ফেসবুকে যে বা যারা প্রশ্ন দিতে ‘বিজ্ঞাপন’ দিচ্ছে তারা বলছে, টাকা পরে দিলেও চলবে, বা না দিতে পারলেও হবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও ঢাকাটাইমকে বলেছেন, ‘সরকারকে বেকায়দায় ফালার জন্যই এসব কাজ করছে দুর্বৃত্তরা। তাদের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নেই। তারা চায় সরকারকে বিতর্কিত করতে।’
শিক্ষামন্ত্রীর এই মতের সঙ্গে একমত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদও। তিনি বলেন, ‘প্রশ্নফাঁস এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। একটি হচ্ছে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফালানো। আরেকটি হচ্ছে অর্থ আয়। যেহেতু তারা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করছে না। সেক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি তারা দেশকে গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্যে ফেলতে চায়। তারা যেটা করছে সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নায়। তবে এদেরকে ধরতে হবে সরকারকেই।’
এবার পরীক্ষা শুরু আগে পরীক্ষার আগে আগে প্রশ্ন ফাঁস রোধে আধা ঘণ্টা আগে থেকে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, ইমোর মতো সামাজিক মাধ্যম বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযু্ক্তি মন্ত্রণালয় এই অনুরোধ রাখেনি।
তবে পরীক্ষার আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী জানান, আইসিটি মন্ত্রণালয় এবং টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিটিআরসির পক্ষ থেকে ‘ইফেকটিভ’ ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
তবে এই ‘ইফেকটিভ’ ব্যবস্থা দৃশ্যত কাজ করেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেন, ফেসবুকে যে প্রশ্ন এসেছে, সেটা আসল প্রশ্ন নয়।
মন্ত্রী বলেন, ‘সকালে যেটা ফাঁসের কথা বলা হয়েছে সেটা কিন্তু আসল নয়। আমি পুরো বিষয়টি সাংবাদিকদের সামনে মিলিয়ে দেখিয়েছি। কিন্তু এরপর এটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আমরা আর কী করতে পারি বলেন?’।
মন্ত্রী বলেন, ‘বিকালে প্রশ্নফাঁস নিয়ে অনেকে রিপোর্ট করেছে। একজন শিক্ষার্থী তো ১২টার পরে এমনিতেই বের হতে পারে। সে যদি বের হয়ে প্রশ্ন ছড়িয়ে দেয় তাহলে তাতে আমাদের কী করার আছে?’।
প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, অপরাধীদের ধরতে হলে শুধু প্রযুক্তির পেছনে ছুটলে হবে না। ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন কীভাবে অপরাধীদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে তার হদিস করা সবার আগে দরকার।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব সালমা বেগম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা প্রশ্নফাঁসকারীদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে আছি। গত বছর এক শিক্ষককের দুই বছর সাজা হয়েছে। ধরা পরলে কেউ রেহাই পাচ্ছে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘জালিয়াতচক্রকে ধরতেই হবে। তাদেরকে কোনো ধরনের সুযোগও দেয়া যাবে না, যাতে তারা সাহসও না পায়। অপরাধীদের শক্তভাবে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে আখতারুজ্জামান বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে ঘটনা ঘটছে সেটা স্যোশাল ক্রাইম। এর বিচার বিদ্যমান আইনের করা না গেলে প্রয়োজনে নতুন আইন করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এই অপরাধ এমন যেটা জাতিকে বিনষ্ট করছে। এটাকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে।’
প্রশ্ন ফাঁসকাকারীরা টাকা পর্যন্ত নিতে চাচ্ছে না। তারা বলছে- ‘আগে প্রশ্ন নাও। সব মিলে গেলে টাকা পরে নেবো’। তাদের এমন ভাষ্য সরকারকে চ্যালেঞ্জ করছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘বিষয়টি তো অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। তাদের চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে হবে, যাতে তারা সুযোগ এবং সাহস কোনোটিই না পায়।’
প্রযুক্তিবিদের পরামর্শ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়- বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় আমরা মর্মহত। বিব্রত। দুষ্কৃতিকারীরা প্রযুক্তিকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে। আর এটিকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করে প্রশ্নফাঁস রোধেরও ব্যবস্থা আছে। সেই দিকে আমাদের যাওয়া উচিত। তাহলে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব।’
‘প্রশ্ন দুইমাস আগে তৈরি করা হয়। এই ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ দুইমাস আগে এনালগ পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করলে সেটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার বিভিন্ন উপায় থাকে।’
তাহলে আপনার পরামর্শ কী-এমন প্রশ্নে কায়কোবাদ বলেন, ‘আমার প্রস্তাব হচ্ছে প্রশ্ন তৈরি হবে পরীক্ষার দিক সকালে। আর সেটি হবে পারমুটেশন, কম্বিনেশন পদ্ধতিতে। কম্পিউটারিই প্রশ্ন করবে। কেউ দেখবে না। র্যানডম স্যাম্পলিং এর মাধ্যমে কম্পিউটার প্রশ্ন তৈরি করবে। আর সেটি অনলাইনে চলে যাবে সেন্টারে সেন্টারে। তাহলে আর ঝুঁকি থাকবে না।’