গত সোমবার অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন–২০১৮’র খসড়া । তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ ৫টি ধারা বিলুপ্ত করা হলেও এ ধারার অনুরূপ বেশকিছু বিধান রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। বিষয়টি অস্বস্তির ও উদ্বেগের। কারণ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ব্যাপক অপব্যবহারের যে প্রবণতা প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ, নতুন আইনের কয়েকটা ধারা নিয়েও একই আশঙ্কা রয়েছে। সাংবাদিক মহলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নতুন আইন বরং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
সরকার যেখানে তথ্য অধিকার আইনের প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছে, সেখানে এই আইন করে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হতে যাবেন কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকের। কেননা আইনটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আর সামগ্রিকভাবে তা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেও হুমকির মুখে ফেলবে।
এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য–উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা সংরক্ষণে সহায়তা করেন, তাহলে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবে।’
এই খসড়া অনুমোদনের সাথে সাথে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে দেশে। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি বলেছেন, আইনটি সংসদে পাস করার আগে সাংবাদিক প্রতিনিধি, শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মীদের মতামত নেওয়া উচিত। আমরাও বলব, বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়ে আইনটিতে যথাযথ পরিবর্তন আনা হোক।
আইনজীবী তানজীব উল আলমের মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, সে প্রসঙ্গে বলা দরকার, তাঁরা তো সরকারি দপ্তরে বেআইনিভাবে প্রবেশ করেন না। কিন্তু দপ্তরে গিয়ে গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করলে কী হবে? ফলে এই ধারাটি দ্ব্যর্থবোধক। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের সঙ্গে এই ধারাটি সামঞ্জস্যপূর্ণ করা দরকার। প্রকৃতপক্ষে এই ধারায় শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না, তবে অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
মিডিয়া আজ মুক্ত, তার পরিধি আজ পৃথিবীব্যাপী। সব জাতি, সমাজ ও বিশ্ব পরিমণ্ডলকে প্রভাবিত ও অবগত করে গণমাধ্যম। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির উত্তরণ ও বিস্ময়কর অগ্রগতিতে সংবাদপত্রের যে বিস্তার ঘটেছে, তা কল্পনাতীত। যুগের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংবাদপত্র পৌঁছে যাচ্ছে গোলার্ধের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রের অন–লাইন সংস্করণ আজ পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করছে। মিডিয়ার কণ্ঠরোধ বা নিয়ন্ত্রণ এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ সংযোজনে। বলা যেতে পারে, মিডিয়া এখন পূর্বেকার সময়ের চাইতে বেশি স্বাধীনতামুখী, সার্বভৌমত্ব প্রত্যাশী ও শক্তিধর। এখানে সংকট আছে, সীমাবদ্ধতা আছে, নিগ্রহ–নিপীড়ন আছে, শ্রমের শোষণ আছে; তবু নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, গণমাধ্যমের অগ্রগতি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীব্যাপী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটি বড় উপাদান হলো সূত্র প্রকাশ না করা। গণমাধ্যম কোন্ সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে, সেটি জানাতে বাধ্য নয়। সংশ্লিষ্টদের দেখার বিষয়, তথ্যটি ঠিক আছে কি না। সাংবাদিক কোথা থেকে এই তথ্য পেলেন, কীভাবে পেলেন, তা জানতে চাওয়া সাংবাদিকতার স্বাধীনতার পরিপন্থী। সেই পরিস্থিতিতে এমন একটি আইনের প্রবর্তন করা স্বাধীনতার প্রশ্নে পিছিয়ে পড়া।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ২০০৯ সালে প্রণীত তথ্য অধিকার আইনে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছিল, বর্তমান আইন তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেই আইনের উদ্দেশ্য ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা এই অধিকার খর্ব করবে। আইনটি যেভাবে করা হয়েছে, তাতে কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছবি প্রকাশ করলেও এই আইনে মামলা করা যাবে। কর্তৃপক্ষ বলতে পারে, এ ছবি তাদের অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা হয়েছে। এসব ধারা যেমন জটিলতা বাড়াবে, তেমনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও সংকুচিত করবে।
অতএব এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, জনগণের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কিংবা হয়রানিমূলক কোনো আইনই আমরা প্রত্যাশা করি না। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রও বাক–স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেবে।