‘জাতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্মেলন–২০১৮’ প্রতি বছরের মতো এবছরও চট্টগ্রামে শুরু হলো ‘সদারঙ্গ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিষদ বাংলাদেশ’র তিন দিনব্যাপী । গতকাল সন্ধ্যায় জেলা শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে সংগঠনটির ২১ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুরু হওয়া সম্মেলনটি উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরু উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁকে উৎসর্গ করা হয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় অনুষ্ঠান আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য অভিনেতা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে এই দেশ পেয়েছি। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি, সেখানে সংস্কৃতির চর্চাই একমাত্র উপায়। আমরা একটি সুন্দর মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে চাই। আমাদের রুচিবান মানুষ গড়া খুব জরুরি। রুচিবান মানুষ গড়তে পারলেই সমাজের রাহাজানি ও হানাহানি দূর হবে।’ মন্ত্রী আরো বলেন, ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা খুব বেশি না। কারণ এটি বোঝার বিষয়। আপনারা যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বুঝি কিনা, আমি বলবো, আমি বুঝি না। কিংবা প্রশ্ন করতে পারেন, ঢাকায় যে পাঁচ দিনব্যাপী ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীত হয় সেখানে তো আপনি পাঁচ দিনই বসে থাকেন। এর উত্তরে আমি বলবো। আচ্ছা আপনার মা যখন আপনাকে জড়িয়ে ধরেন, তখন আপনার কেমন লাগে, নিশ্চয়ই বলে ভালো লাগে। কিছু ভালো লাগার কোনো মানে থাকে না। এটি শুধু অনুভব করার বিষয়।’
আসাদুজ্জামান নুর বলেন, ‘আমাদের ধানের ক্ষেত দেখতে ভালো লাগে, কেন ভালো লাগে। কিংবা শরতের আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়, দেখতে ভালো লাগে, কেন ভালো লাগে। এছাড়া অনেকের সমুদ্র দেখতে ভালো লাগে, কেন ভালো লাগে, সেটি কেউ বলতে পারে না। সবকিছু বুঝতে হবে এমন কোনো কথা নেই। চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁকেন, সবকিছু কি আমরা বুঝি, বুঝি না। তারপরেও আমরা মনে মনে তার একটা মানে বুঝে নিই। আপনার ভালো লাগছে কিনা সেটাই হলো বড় কথা। সব কথার মূল কথা হচ্ছে, ভালো লাগা। ভালো লাগা ও ভালোবাসা হচ্ছে বড় বিষয়। আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি, আমাদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসি।’
সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘একমাত্র সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মানুষের মনের অন্ধকার দূর হতে পারে। আমাদের সৌভাগ্য আমরা সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবে এমন একজনকে পেয়েছি, যিনি সংস্কৃতির একজন মহীরুহ। সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় ওনার বিচরণ। আমরা আশা করি দেশের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন।’
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক পণ্ডিত স্বর্ণময় চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের কাছে দেশ আগে। বাংলাদেশে এই সংগঠন প্রথম অনুভব করল শিল্পীকে সম্মানিত করা একটি মহান দায়িত্ব। সেই বোধ থেকে দেশের অবহেলিত শিল্পীদের যথাসাধ্য সম্মানিত করার চেষ্টা শুরু হয়। সর্বোপরি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এটিই একমাত্র সম্মেলন যাতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের মধ্যে আশি ভাগ দেশের শিল্পী থাকেন। এছাড়া সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের উদ্দেশ্যে বাকি শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয় বিদেশ থেকে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বিষয়ে দেশের এখনও পর্যন্ত একমাত্র নিয়মিত প্রকাশনা ‘সুরশৃঙ্গার’ প্রকাশিত হয়ে আসছে নিয়মিতভাবে। এর পেছনে রয়েছেন সদারঙ্গের একদল নিবেদিত কর্মীবাহিনী।’
তিনি আরো বলেন, ‘সদারঙ্গ সারাদেশে নিয়মিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি জেলাতেও আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। দেশিয় শিল্পীর বাইরে সদারঙ্গের অনুষ্ঠানে ইতোমধ্যে অংশ নিয়েছেন স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের গুণী শিল্পীরা। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সংগীত চর্চার মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা। শিক্ষিত মানে কেবল একটি সনদ নয়। আমরা একটি আধুনিক রুচিশীল সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছি।’
অনুষ্ঠানের দর্শক সারিতে অন্যান্যদের মধ্যে প্রফেসর তপনজ্যোতি বড়ুয়া, প্রফেসর ড. রাশিদা খানম, প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দীকী, সঙ্গীত জগতের বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গ ও সংস্কৃতিকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
সদারঙ্গের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় সন্ধ্যা ৬টায়। সমবেত সঙ্গীত রাগাঞ্জলি দিয়ে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এটি রচনা করেন পণ্ডিত স্বর্ণময় চক্রবর্তী। রাগ ইমন, রাগ কেদার, রাগ ভূপালী, রাগ ভীমলস্ত্রী ও রাগ দুর্গার সাথে ত্রিতাল, একতাল, চৌতাল, কাহারবা ও ঝাঁপ তালে নিবদ্ধ এই সঙ্গীত পরিবেশন করেন সদারঙ্গের সদস্যরা। এরপর একক পরিবেশনার শুরুতে রাগযোগ পরিবেশনা করেন চট্টগ্রামের শিল্পী ফাল্গুনী বড়ুয়া। তিনি প্রথমে একতাল বিলম্বিত লয়ে এবং পরে দ্রুত ত্রিতালে খেয়াল পরিবেশন করেন। শিল্পীকে তবলায় সহযোগিতা করেন চট্টগ্রামের শিল্পী রাজিব চক্রবর্তী, হারমোনিয়ামে প্রমীত বড়ুয়া, তানপুরায় শুভাগত রায় চৌধুরী ও ত্রপা দাশগুপ্তা। প্রথম দিনের শেষ পরিবেশনা চন্দ্রকোষ পরিবেশন করেন নারায়গঞ্জের ‘আহমেদ ব্রাদার্স’ খ্যাত সবুজ আহমেদ, শান্ত আহমেদ ও কামরুল আহমেদ। হলভর্তি দর্শকরা বাঁশি, বেহালার সুরের ঝঙ্কারে মন্ত্রমুগ্ধদের মতো উপভোগ করেন পুরো অনুষ্ঠান। আজ দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশন শুরু হবে সকাল ১০টায়। এসময় ‘খেয়াল গানে বন্দেশ এর গুরুত্ব’ শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টায়। এছাড়া আগামীকাল সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশন শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টায়। এতে গুণী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। অনুষ্ঠান চলবে রাত ১০টা পর্যন্ত।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের লালন, চর্চা, প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে ‘সদারঙ্গ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিষদ বাংলাদেশ’ নামে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। বর্তমান কালের পূর্ণাঙ্গ খেয়াল গানের যে রূপ সেটি যিনি দান করেন তিনি হলেন উস্তাদ নিয়ামত হোসেন খান। অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছিলেন ‘সদারঙ্গ’ উপাধি। তার নামে সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘সদারঙ্গ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিষদ বাংলাদেশ’। কার্যক্রম শুরুর কয়েক বছরের মধ্যেই সংগঠনের সাথে যুক্ত হন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। মৃত্যুর আগ পর্যনন্ত তিনি ১৪ সদারঙ্গের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে সংগঠনটির সভাপতি হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। সংগঠনটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগ খোলার জন্য গত ২০০৩ সাল থেকে আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীতে গত ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগ খোলা হয়।