কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র আদনান ইসফারকে খেলা নিয়ে সামান্য কথা কাটাকাটি, তার মূল্য বড়ো নির্মমভাবে দিতে হলো। তাতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে স্থানীয় ‘বড় ভাই’দের তুষ্ট করে বীরত্ব জাহিরের চেষ্টা। ঘটনায় সরাসরি অংশ নেয়া পাঁচজন ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। তবে নেপথ্যে ইন্ধনদাতা সেই ‘বড় ভাই’ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। গ্রেফতারকৃতরা হলো, নগরীর চান্দগাঁওয়ের হাজেরা তজু কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র মঈন খান, সাব্বির খান ও মুনতাসির মোস্তফা, চকবাজার ডিসি রোডের হলি ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী এখলাছ উদ্দীন আরমান এবং ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে সদ্য এইচএসসি পাস করা আবদুল্লাহ আল সাঈদ। তাদের সবার বয়স ১৮ বছরের মধ্যে বলে জানিয়েছে পুলিশ। কোতোয়ালী থানার ওসি মো. জসিম উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সিসি টিভি ফুটেজে দেখা গেছে আদনানকে ছুরিকাঘাত করে মঈন। আর আব্দুল্লাহ আল সাঈদ তাকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। গ্রেফতার সবাই সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। মুনতাসিরকে নগরীর বাদুরতলা এবং বাকি ৪ জনকে ফটিকছড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর তারা ফটিকছড়িতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিল। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছোরাও উদ্ধার করা হয়েছে। এঘটনায় আদনানের বাবা আখতার আজম বাদি হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার একটি মামলা করেছেন। এতে গ্রেফতার হওয়া ৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আরও ৪–৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ঘটনার নেপথ্যে কারণ : আদনান হত্যাকাণ্ডের পরপরই অভিযানে নামে পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ঘটনার ঘন্টা তিনেকের মধ্যে পুলিশ হামলাকারীদের ছবি পেয়ে যায়। হামলার ঘটনা যে রাজনৈতিক বা প্রেম সংক্রান্ত বিষয় নয়, সে ব্যাপারটিও নিশ্চিত হয়ে যায়। তদন্ত এগুতে থাকে পূর্বের কোন ঘটনার জেরকে কেন্দ্র করে। আদনানের কয়েকজন ঘনিষ্ট বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ। দেখা যায় অনুমান সঠিক। কিছুদিন আগে মহসিন কলেজ মাঠে খেলাকে কেন্দ্র করে তার সমবয়সী কয়েকজন ছাত্রের সাথে আদনান ও তার বন্ধুদের কথা কাটাকাটি হয়। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ এবং গ্রেফতার পাঁচজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এডিসি রউফ জানান, সপ্তাহখানেক আগে মহসিন কলেজের মাঠে খেলা নিয়ে আদনান ও তার বন্ধুদের সঙ্গে জামালখানের আইডিয়াল স্কুলের দুই ছাত্রের কথা কাটাকাটি হয়। শুধু তাই নয়, আদনানের উপর হামলার আগে সে ও তার বন্ধুরা ঐ দুই শিক্ষার্থীকে ধাওয়া দিয়েছিল। হিসেব মেলাতে কষ্ট হয় না আর। তাদের বাসার ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে অভিযান চালায় পুলিশ। ঘটনায় জড়িতরা আত্মরক্ষায় মোবাইল সিম বদলে ফেলে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। বুধবার রাতে ফটিকছড়ির এক বাড়ি থেকে চারজন ধরা পড়ে। তাদের তথ্যে এক জনকে বাদুরতলা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অতিরিক্ত উপ কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মোহাম্মদ আবদুর রউফ আজাদীকে বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি মহসিন কলেজের মাঠে খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে আদনান খুন হয়। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি এর সঙ্গে জড়িত।

গ্রেফতারকৃতরা যা জানায় : গ্রেফতারকৃত পাঁচ কিশোর জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে ঘটনার বিবরণ দেয়। তাদের দেয়া তথ্যমতে, অতিরিক্ত উপ কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মোহাম্মদ আবদুর রউফ আজাদীকে বলেন, ঘটনার দিন ১৬ জানুয়ারি দুপুর ১টার দিকে আইডিয়াল স্কুলের দুই ছাত্রকে জামালখান মোড়ে দেখে ধাওয়া দেয় আদনান ও তার কয়েকজন বন্ধু। মঈন, সাব্বির, সাঈদ, আরমান ও মুনতাসির এবং আরও তিনজন রাজনৈতিক ‘বড় ভাই’ তখন আইডিয়াল স্কুলের বিপরীতে একটি রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিচ্ছিলেন। ধাওয়া খেয়ে আইডিয়াল স্কুলের দুই ছাত্র তখন দৌঁড়ে ওই হোটেলে ঢুকে পড়ে। সেখানে আড্ডারত বড় ভাইদের সাহায্য চায় তারা। তখন মঈন, সাব্বির, সাঈদ, আরমান ও মুনতাসির হোটেল থেকে বেরিয়ে আদনানদের পাল্টা ধাওয়া দেয়। আদনানকে ফেলে তার বন্ধুরা পালিয়ে যায়। সাব্বির এসে আদনানের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয় এবং কিল–ঘুষি মারতে থাকে। আরমান ও সাঈদ লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। আদনান দৌঁড়ে পালানোর সময় জামালখানে খাজা আজমির ওয়ার্কশপের সামনে একটি সিএনজি অটোরিকশার সঙ্গে ধাক্কা লেগে রাস্তায় পড়ে যায়। উঠে আবারও দৌঁড়ে পালানোর সময় মুনতাসির পেছন থেকে টি–শার্ট টেনে ধরলে পেছনের অংশ ছিঁড়ে রাচ্চায় পড়ে থাকে। তখন মঈন সামনে থেকে এসে আদনানের পেটের একপাশে ছুরিকাঘাত করে। এরপর চারজন পেছনদিকে গণি বেকারির দিকে চলে যায়। ছুরিকাহত আদনান জামালখান মোড়ে খাস্তগীর স্কুলের দিকে দৌঁড়ে যেতে যেতে পড়ে যায়। মঈন তার পেছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে খাস্তগীর স্কুলের কাছাকাছি পর্যন্ত যায়। পরে আবার পেছন ফিরে গণি বেকারির দিকে চলে যায়। পরে বন্ধুরা এসে আদনানকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সিসিটিভি ফুটেজে দৌঁড়ে যাওয়ার সময় আদনানের ডান পা থেকে রক্ত ঝরতে দেখা গেছে।

এডিসি রউফ জানান, বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ঘটনায় জড়িতরা আরমানের মৃত্যুর খবর পায়। এরপর তারা বাদুরতলা এলাকায় চলে যায়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তারা ফটিকছড়ির সমিতিরহাটে জনৈক ফয়সালের বাড়িতে পৌঁছায়।

গতকাল আদনান খুনের ঘটনায় জড়িত পাঁচ কিশোরকে গ্রেফতার পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও সাংবাদিকরা পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে নেপথ্যের বড় ভাইদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। কেননা নগরীর চকবাজার–গণি বেকারি এলাকার গ্রেফতারকৃতরা ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম কলেজ–মহসিন কলেজে আধিপত্য বিস্তারের জন্য কিশোর বয়সী এসব কর্মীদের ব্যবহার করেন চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রউফ। নগর পুলিশের উপ–কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডে রউফের সম্পৃক্ততা আমরা এখনও পাইনি। তথ্য পেলে তাকেও গ্রেফতার করা হবে। বড় ভাই, ছোট ভাই যাদের বিষয়ে তথ্য পাবো, তাদেরই গ্রেফতার করবো।’ তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত মূল হোতাসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর পেছনে আর কোনও কারণ আছে কিনা আমরা জানার চেষ্টা করছি।’

এ বিষয়ে অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. আব্দুর রউফ বলেন, ’ঘটনার সঙ্গে গ্রেফতার পাঁচজন ছাড়াও আরও ৪/৫ জন জড়িত থাকতে পারে। ঘটনার সময় তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। এই অস্ত্রদাতা, অর্থায়নকারী এবং নেপথ্যে যারা আছে আমরা তাদের ধরার চেষ্টা করছি।’

পুলিশের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে কিছু বলা না হলেও পুলিশেরই সিনিয়র একজন কর্মকর্তা আজাদীকে বলেছেন, ভাই এখন পাড়ায় মহল্লায় সব খানেই ছাত্রলীগের পরিচয়ে অপরাধ করছে কিশোর সন্ত্রাসীরা। তারা নামে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের কোন কমিটিতে তারা নেই। এলাকায় সবাই তাদের ছাত্রলীগ কর্মী বলেই সমঝে চলে। তাঁর কথার সত্যতা মিলেছে এলাকায় গিয়ে। চন্দনপুরা, গণি বেকারি এলাকায় গ্রেফতারকৃতদের রাজনৈতিক পরিচিতি স্থানীয়রা জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, হত্যাকান্ডের পর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত চারজনকে ফটিকছড়ির সমিতিরহাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মো.ফয়সালের বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। খুনিরা যে পিস্তল ব্যবহার করেছিল সেটি তাদের দিয়েছিল এলাকার এক রাজনৈতিক বড়ভাই। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে গ্রেফতারকৃতরা চন্দনপুরা এলাকার আবদুর রউফ নামে এক আওয়ামী লীগ নেতার শেল্টারে চলে। রউফের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন জামালখান এলাকার ছাত্রলীগ নেতা শাব্বির আহমদ। শাব্বিরের অনুসারী ছিল আদনান। তাদের বাড়িও পাশাপাশি। পাঁচজনের মধ্যে সাব্বির ও সাঈদ দুজনই দুই মামলার আসামি।

চকবাজার থানায় একটি মামলা হয় গত বছরের ১২ ডিসেম্বর। নগরের বাকলিয়া এলাকার হাছিনা আক্তার নামের এক গৃহিণী মামলাটি করেন। মামলার এজাহারে হাছিনা বলেন, ১১ ডিসেম্বর নগরের গনি বেকারি এলাকার একটি রেস্তোঁরায় তাঁর বোনের ছেলে ফয়সাল বন্ধুবান্ধবীদের নিয়ে জন্মদিনের পার্টি করেন। অনুষ্ঠান শেষে বের হলে সাঈদ, সাব্বিরসহ একদল যুবক ফয়সালের এক বান্ধবীকে উত্ত্যক্ত করেন। প্রতিবাদ করায় ফয়সাল ও তাঁর বন্ধু দিহানকে ছুরিকাঘাত করেন ওই যুবকরা। কেড়ে নেওয়া হয় পকেটে থাকা মুঠোফোন ও ৪০ হাজার টাকা। মামলায় সাঈদ ও সাব্বির ছাড়াও তাঁদের পাঁচ সহযোগীকে আসামি করা হয়েছে।

সাঈদ ও সাব্বিরের বিরুদ্ধে অপর মামলাটি হয় গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম আদালতে। চন্দনপুরার রাজিয়া সুলতানা নামের এক নারী মামলায় তাঁকে মারধরের অভিযোগ করেন। এ মামলায়ও সাঈদ ও সাব্বিরের পাশাপাশি তাঁদের পাঁচ সহযোগী আসামি। আদালত চকবাজার থানা–পুলিশকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031