প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহাকে নিয়ে মন্তব্য করায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ খ ম মোজাম্মেল হককে শাসালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে তাদের মন্তব্যের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের মন্তব্য থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
রায় ঘোষণার আগেই প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে দুই মন্ত্রী ও সাবেক এক বিচারপতির বিতর্কিত মন্তব্যে বিচার অঙ্গনসহ দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সর্বমহলে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। আইন বিশেষজ্ঞরা তাদের বক্তব্যকে অসাংবিধানিক, অনাকাঙ্খিত এবং বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে অভিহিত করেন। আর দুই মন্ত্রীর বিচার দাবি করেছে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই দুই মন্ত্রীকে সতর্ক করে দিলেন।
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের বক্তব্যকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও আদালত অবমাননাকর হিসেবে দাবি করা হয়। এছাড়া রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার মতে, প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করা মানেই বিচার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা। কোনোভাবেই এটা না করার আহবান জানিয়েছেন তিনি।
এক প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সাবজুডিশ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করলে খারাপ নজির হয়ে যাবে।’
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে একজন আইনজীবী ও প্রাক্তন আইন প্রতিমন্ত্রী (বর্তমানে খাদ্যমন্ত্রী) এবং আপিল বিভাগ থেকে সদ্য অবসর নেয়া একজন বিচারপতির কাছ থেকে যেসব অভিযোগ ও মন্তব্য এসেছে তা বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তদুপরি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে উত্থাপিত অভিযোগ সত্য বলে পক্ষান্তরে দাবি করা ভয়ানক বিবেচনাহীনতার পরিচায়ক। সর্বোপরি এ ধরনের মন্তব্য সবার মধ্যে আস্থাহীনতার জন্ম দেবে।
পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার ব্যাপারে সাংঘাতিক বিরূপ মন্তব্য শুধু নিন্দনীয়ই নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরির কারণ হতে পারে। এ ধরনের বক্তব্য বিচার বিভাগের জন্যও হুমকিস্বরূপ। রাষ্ট্র, বিচার বিভাগ ও বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থে বিতর্কিত এসব মন্তব্য থেকে অবিলম্বে সবাইকে সম্পূর্ণ বিরত থাকার আহবান জানান তিনি। পাশপাশি দায়িত্বহীন ব্যক্তিদের অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্য প্রচার না করার জন্য দায়িত্বশীল মিডিয়াগুলোর প্রতিও আহবান জানিয়েছেন বিশিষ্ট এই আইনজীবী।
আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর অঙ্গটি হচ্ছে ‘বিচার বিভাগ’। বিচার বিভাগ মানুষের ন্যায়বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল। তাই বিচার বিভাগকে সব সময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। কিন্তু এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে প্রকারান্তরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেয়ার প্রচেষ্টা চলছে।
তাদের মতে, বিতর্কিত এসব মন্তব্য এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। তারা মনে করেন, যুগ যুগ ধরে ট্র্যাডিশন হচ্ছে বিচারাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করা। কিন্তু রায় ঘোষণার আগেই দু’জন মন্ত্রী ও সাবেক এক বিচারপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিব্রতকর।
প্রসঙ্গত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামে বদর কমান্ডার ছিলেন মীর কাসেম আলী। ইতিমধ্যে তার মৃত্যুদ-ের রায় দিয়েছেন এ সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে এর শুনানিও শেষ হয়েছে। রায় ঘোষণার দিন ধার্য হয়েছে আগামীকাল।
কিন্তু রায় ঘোষণার আগে ৫ মার্চ শনিবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সরকারের দু’জন মন্ত্রী এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতিকে জড়িয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন।
খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মীর কাসেম আলীর আপিল শুনানি পুনরায় করা উচিত।
অপরদিকে একই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আর প্রধান বিচারপতি যদি উন্মুক্ত আদালতে এমন কথা বলে থাকেন তাহলে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে তার এটা বোঝা উচিত। এটা করে থাকলে এটার প্রতিকার কী- এটা তিনি নিশ্চয় জানেন। হয় তিনি এটা প্রত্যাহার করে নেন। আর না হয় প্রধান বিচারপতির আসনে থাকার সুযোগ কতটুকু আছে তা তার ওপরই রাখতে চাই।’
তারা (দুই মন্ত্রী) ওই আলোচনা সভায় এমন অনেক মন্তব্য করেন যা আদালত অবমাননাকর হওয়ায় উল্লেখ করার মতো নয়।
এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিমকোর্টে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মামলা শুনানিকালে তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের বিভিন্ন দুর্বল দিক তুলে ধরে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার তীব্র সমালোচনা করা হয়। তবে আদালতের ওইদিনের সমালোচনার পর বিষয়টি নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি।
এদিকে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক এ প্রসঙ্গে ৬ মার্চ রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি যখন আইনজীবী ছিলাম তখনও কোনো সাব-জুডিস (বিচারাধীন) বিষয়ে মন্তব্য করিনি। এখন দেশের আইনমন্ত্রী। এখনও সাব-জুডিস বিষয়ে কোনো মন্তব্য করলে খারাপ নজির হয়ে যাবে। এটুকুই বলতে পারি। তবে যার যার ব্যক্তিগত মতামত দেয়ার স্বাধীনতা রয়েছে। উনারা (দুই মন্ত্রী) হয়তো তাদের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়েও কোনো মন্তব্য করব না।’
দুই মন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এগুলোর ব্যাপারে মন্তব্য না করাই ভালো। সম্পূর্ণভাবে এগুলো অসাংবিধানিক উক্তি।’
এ ধরনের মন্তব্য এড়ানোর পাশাপাশি এ রায় নিয়ে সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি। রায়ের তিন দিন আগে দুই মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার মধ্যে রোববার নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি একটি দেশের বিচারব্যবস্থার প্রধান। সুতরাং তাকে বিতর্কিত করা মানেই বিচারব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা। তাই এসব উক্তি করা থেকে বিরত থাকার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
বিচার বিভাগ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
বিষয়টি কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমাদের সর্বোচ্চ আদালতে যেসব আপিলের শুনানি হয়, এগুলো যে কোনো একজন বিচারপতির সিদ্ধান্তে ঠিক হয় না। এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সবার মতামতের আলোকে। এখানে যুদ্ধাপরাধের মামলা যখন শুরু হল, প্রথম মামলাটির রায় দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। কাদের মোল্লার সেই রায়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কীভাবে হবে, এর মানদ- কেমন হবে প্রভৃতি বিষয়ে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, ‘একজন আইনজীবী ও অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে এই মামলাগুলোর ব্যাপারে আমার কর্মদক্ষতা, আন্তরিকতাসহ ইত্যাদি বিষয় সাঈদীর মামলার রায়ে ভালোভাবে উল্লেখ করা আছে। আমি মনে করি, একজন আইনজীবীর জীবনে চরম প্রাপ্তি আমি একটি রায়ের মাধ্যমে পেয়েছি। কাজেই অন্য কে কী বলল এগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করা অনর্থক।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা যখন হয় তখন বহু কথা উঠেছিল, বহু মুখরোচক গল্প শুনেছি।’
তিনি বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় কী হয়েছে সেটা আপনারা দেখেছেন. . .। কাজেই অপেক্ষা করুন, বিচার বিভাগের প্রতি সবার আস্থা রাখুন। কারণ বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের ভেতর প্রধান একটি অঙ্গ। এটাকে বিতর্কিত না করাই সবচেয়ে ভালো।’
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মন্ত্রীকে সংবিধান রক্ষার শপথ নিতে হয়। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেলের ভাষায় উনারা অসাংবিধানিক মন্তব্য করে থাকলে সেক্ষেত্রে তাদের শপথ ভঙ্গ হয়েছে। আর শপথ ভঙ্গ হলে তাদের মন্ত্রী থাকার কোনো অধিকার নেই।’
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |