নাওয়া খাওয়া নেই শিক্ষার্থীদের। টেনশন আর টেনশন। আগের রাত অথবা পরীক্ষার দিনের সকাল। বইয়ে মুখ গুঁজে রাখা। এতকাল ধরে এই ছিল বাংলাদেশের পরীক্ষার চিত্র। খারাপ সময় যে যায়নি তা নয়।
একটা সময় পাবলিক পরীক্ষায় নকল মহামারি আকার ধারণ করেছিল। নকলের সেই প্রবণতা ছিল এসএসসি, এইচএসসি বা তার উপরের শ্রেণিতে। পরে তা আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণে আসে। গত কয়েক বছরে নতুন এক ক্যানসারের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে ছোট ছোট শিশুরাও আক্রান্ত এই ক্যানসারে। খুব ছোট বেলাতেই তাদের দুর্নীতির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন অভিভাবকরা। নীতি আর নৈতিকতার কোনো বালাই নেই। পরীক্ষায় ভালো ফলই একমাত্র চাওয়া। নীতিনির্ধারকদেরও অবশ্য কোনো বিকার নেই। কখনও তারা প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উড়িয়ে দেন। কখনো বলেন, শিক্ষকরা দায়ী। নৈতিকতার এই মৃত্যুর সময়ে যেন তাদের কিছুই করার নেই।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, প্রশ্ন ফাঁস হওয়া, মুখস্থ করা, কোনো না কোনোভাবে পরীক্ষায় পাস করা- একটা অনৈতিক ও অসুন্দর প্রতিযোগিতা চলছে। এটি সমাজের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। এতে করে শিক্ষার সঙ্গে আমাদের যে নৈতিক সম্পর্ক সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা এখন আর মানুষকে আলোকিত করছে না। মনে হচ্ছে শিক্ষা এখন আর সম্পদ নয় বোঝা। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যরা যখন কালো টাকার সম্পদ করেন, ঘুষ খেয়ে অর্থবিত্তের মালিক হন তখন দেখা যায় যে তাদের মধ্যে নৈতিকতা থাকে না এবং আমদের দেশে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা প্রচুর। এখন সন্তানকেও যে দুর্নীতির চক্রের ভেতর জড়িয়ে ফেলা, এতে প্রমাণ হয় যে আমাদের মাঝে একটি ঘোরতর নৈতিকতার অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। এখন এই শিক্ষা আামদের কতদূর নিয়ে যাবে? এই শিক্ষার উদ্দেশ্যই বা কি এর কোনো উত্তর আমার জানা নেই। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, অনাবশ্যক পাবলিক পরীক্ষা বিশেষ করে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। এসব পরীক্ষার জন্য বেশির ভাগ বাচ্চা তৈরি হয় না। এসব পরীক্ষার কারণে কোচিং সেন্টারগুলো প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা অনৈতিক কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছে। পিএসসি এবং জেএসসির বিকল্প হিসেবে শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়ণ পদ্ধতিই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, কোচিং সেন্টার বন্ধ করা এবং প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সরকারকে করতেই হবে। এটি সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। না হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রত্যেকটি সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করবে। আর যেখানে এই প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সন্ধান পাওয়া যায় তাদেরকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
প্রশ্ন ফাঁস এবং তা পাওয়ার প্রবণতা শিশু মনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন মনোবিশ্লেষক ডা. মোহিত কামাল। তার মতে, শিশুরা ভয় পেয়ে যায় যে অন্যরাতো প্রশ্ন পেয়ে তার চেয়ে ভালো করছে। এতে করে শিশুদের আত্মবিশ্বাস ও মনোসংযোগে ঘাটতি দেখা দেয়। তখনই ওই শিশু প্রশ্ন পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আর যারা পায় না তারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। আর যারা ফাঁস করা প্রশ্ন পেয়েছে তাদের মধ্যে একটি চোর চোর ভাব থাকবে। এভাবেই বাচ্চারা মনস্তাত্ত্বিকভাকে ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে। এভাবেই আমরা শিশুদের ভুল পথে ঠেলে দিচ্ছি। তিনি বলেন, আমার সন্তানকে ভালো করতে হবে, গোল্ডেন প্লাস পেতে হবে- এই যে প্রবণতা অনেকের মনে ঢুকেছে এর জন্য আমি কাকে দায়ী করবো? সমাজকে দায়ী করবো? না কি যারা এই প্রশ্ন ফাঁসের মতো অপকর্ম করছে তাদের দায়ী করবো। কিন্তু অপরাধীরাতো পার পেয়ে যাচ্ছে। ডা. মোহিত কামাল আরো বলেন, প্রশ্ন ফাঁস হলে বাচ্চারা পরীক্ষার আগের দিন বাসায় বসে এর সমাধান করছে। সেজন্য বাচ্চাদের আমরা অপরাধী ভাবছি। কিন্তু আমি মোটেও বাচ্চাদের অপরাধী ভাবছি না। আমি ভাবছি তাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। কারণ তারা অনৈতিকভাবে উপরে ওঠতে চায়। তাই যে কারণে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে সেই শিকড়টা উপড়ে ফেলতে হবে। ডা. মোহিত কামাল বলেন, যারা প্রশ্ন ফাঁস করছে তারা মহা অনৈতিক কাজ করছে। তারা অপরাধী, খুনি। এভাবে তারা শিশুদের ভবিষ্যৎকেই খুন করছে। আগে ওই অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলনও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অভিভাবকরা যখন চিন্তা করে তার সন্তান প্রতিযোগিতায় টিকবে কি টিকবে না, তখন সন্তানের মঙ্গলের চিন্তায় সামাজিক আন্দোলনও খর্ব হয়ে যায়।
আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে প্রাথমিক সমাপণী পরীক্ষা। এ পরীক্ষাতেও কি এ প্রশ্ন ফাঁসের উৎসব হবে সে প্রশ্ন এরই মধ্যে উঠেছে। বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বিষয়ের পরীক্ষায় শেষ হয় এবারের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট-জেএসসি পরীক্ষা। যথারীতি এ দিনও পরীক্ষার ঘণ্টাখানেক আগে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। অনেক অভিভাবক আর শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায় প্রশ্ন। রাজধানীর বেশ কিছু পরীক্ষার কেন্দ্রের সামনে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র মেলাতে দেখা যায়। অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেছেন, তারা চেষ্টা করছেন প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে, কিন্তু পারছেন না। বৃহস্পতিবার সকালে মিরপুরের এম ডি সি মডেল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পৌনে ৯টার পর থেকেই শিক্ষার্থীরা জটলা করে কেন্দ্রের বাইরে মোবাইল ফোনে প্রশ্ন ও তার উত্তর দেখছেন। সেখানে ‘খ’ সেটের ‘দিকপাল’ প্রশ্নটি মোবাইলে পড়ছিলেন এক শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে কথা বললে তিনি প্রশ্ন পাওয়ার কথা স্বীকার করেন।
সুলতান মোল্লা স্কুলের আরেক শিক্ষার্থী তার বোনের পাশে দাঁড়িয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন-উত্তরে চোখ বুলাচ্ছিলেন। তিনি প্রশ্নের একটি কপি শেয়ার ইটে এ প্রতিবেদককে দেন। এই শিক্ষার্থী জানান, তার দুলাভাই তাকে আগে বলে রেখেছিলেন প্রশ্ন পাবেন। তিনি ৯টার কয়েক মিনিট পর একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে প্রশ্নটি সংগ্রহ করে তাকে পাঠিয়েছেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে অভিভাবকদের এই সহযোগিতার দৃশ্য দেখা গেছে কেন্দ্রের সামনেও। এ কেন্দ্রের এক শিক্ষার্থী পরীক্ষার সময় হয়ে গেছে বলে দ্রুত পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকতে চাইলে তার মা তাকে পরে ঢুকতে বলেন। সন্তানকে তিনি বলেন, এখন ভালো করে প্রশ্নের উত্তরগুলো পড়ে নাও। ৫ মিনিট আগে ঢুকলেই হবে।
এ প্রশ্ন যদি পরীক্ষায় না আসে তখন কী করবেন-এ প্রশ্নের জবাবে ওই শিক্ষার্থী বলে, সকালে যে প্রশ্নটা পাই সেটাই তো আসে। সব পরীক্ষায় সকালে যে প্রশ্নটা পেয়েছি, সেটাই এসেছে। আর ‘খ’ সেটের ‘দিকপাল’ প্রশ্নটি ৪-৫টা পরীক্ষায় এসেছে। এটা আসবে নিশ্চিত। সকালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রের সামনেও জটলা করে শিক্ষার্থীদের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও উত্তর পড়তে দেখা যায়। সাড়ে ৯টার দিকে ফেসবুক মেসেঞ্জার আর হোয়াটস অ্যাপে ইমেজ আকারে ‘খ’ সেট ‘দিকপাল’ নামে বোর্ড প্রশ্নের একটি সেট আসে, তার সঙ্গে হাতে লেখা বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তরও পায় শিক্ষার্থীরা। ওই প্রশ্ন-উত্তর নিয়ে ব্যস্ত শিক্ষার্থীদের একজনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যারা প্রশ্ন পায় তারা পরীক্ষার হলে কখন ঢোকে? জবাবে তিনি বলেন, “যারা প্রশ্ন পায় তারা পরীক্ষার পাঁচ মিনিট আগে ঢোকে, যারা পায় না তারা আরো আগেই ঢুকে যায়। প্রশ্ন পেয়ে উত্তর পড়ে তারপর ঢোকে, তাই ওরা পাঁচ মিনিট আগে ঢোকে। সব প্রশ্নই (পরীক্ষার) আগে পাওয়া গেছে।” ছেলে এত দেরিতে পরীক্ষার কেন্দ্রে যাচ্ছে কেন- এ প্রশ্নের জবাবে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের এক শিক্ষার্থীর মা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমসিকিউয়ের উত্তর দেখে যাচ্ছে। সাংবাদিক বুঝতে পেরে তিনি বলেন, “রিভিশন করছে।” দুপুর ১টায় পরীক্ষা শেষ হলে মতিঝিল মডেল হাই স্কুলের এক পরীক্ষার্থী জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় তারা যে প্রশ্ন পেয়েছিলেন ‘খ’ সেটের, সেটিই হুবহু এসেছে মূল পরীক্ষায়, বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর সবক’টি সঠিক হয়েছে তার। একই কথা বলেন আরো কয়েকজন পরীক্ষার্থী।
প্রশ্নের জন্য যে টাকা দিতে হয় তা কোথায় পান- এই প্রশ্নের উত্তরে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলের এক পরীক্ষার্থী বলে, তারা চার-পাঁচজন বন্ধু মিলে টাকা দিয়ে প্রশ্ন কেনেন, তারপর অন্য বন্ধুদেরও দেন। “প্রশ্নের টাকা তো একা দিতে পারি না। একজন যোগাযোগ করে প্রশ্ন নেই তারপর চার-পাঁচ জন মিলে টাকা দিই। বাসা থেকে নিই টাকা।” সকালে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের অনুলিপি দেখে ৯টা ৫৮ মিনিটে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকারকে বিষয়টি জানানো হয়। তখন তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষা শেষ হলে দেখা যাক, ওই সেট পরীক্ষায় এসেছে কি না।” পরে পরীক্ষা শেষে বেলা দেড়টার দিকে তাকে ফোন করে ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই পরীক্ষা হওয়ার কথা জানালে দৃশ্যত অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তিনি। “আমরা চেষ্টা করছি এটা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু আমারও প্রশ্ন, এটি বন্ধ হচ্ছে না কেন?” প্রশ্ন ফাঁস রোধে অভিভাবকদের সচেতনতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, প্রশ্ন ফাঁস হওয়া, মুখস্থ করা, কোনো না কোনোভাবে পরীক্ষায় পাস করা- একটা অনৈতিক ও অসুন্দর প্রতিযোগিতা চলছে। এটি সমাজের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। এতে করে শিক্ষার সঙ্গে আমাদের যে নৈতিক সম্পর্ক সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা এখন আর মানুষকে আলোকিত করছে না। মনে হচ্ছে শিক্ষা এখন আর সম্পদ নয় বোঝা। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যরা যখন কালো টাকার সম্পদ করেন, ঘুষ খেয়ে অর্থবিত্তের মালিক হন তখন দেখা যায় যে তাদের মধ্যে নৈতিকতা থাকে না এবং আমদের দেশে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা প্রচুর। এখন সন্তানকেও যে দুর্নীতির চক্রের ভেতর জড়িয়ে ফেলা, এতে প্রমাণ হয় যে আমাদের মাঝে একটি ঘোরতর নৈতিকতার অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। এখন এই শিক্ষা আামদের কতদূর নিয়ে যাবে? এই শিক্ষার উদ্দেশ্যই বা কি এর কোনো উত্তর আমার জানা নেই। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, অনাবশ্যক পাবলিক পরীক্ষা বিশেষ করে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। এসব পরীক্ষার জন্য বেশির ভাগ বাচ্চা তৈরি হয় না। এসব পরীক্ষার কারণে কোচিং সেন্টারগুলো প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা অনৈতিক কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছে। পিএসসি এবং জেএসসির বিকল্প হিসেবে শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়ণ পদ্ধতিই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, কোচিং সেন্টার বন্ধ করা এবং প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সরকারকে করতেই হবে। এটি সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। না হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রত্যেকটি সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করবে। আর যেখানে এই প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সন্ধান পাওয়া যায় তাদেরকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
প্রশ্ন ফাঁস এবং তা পাওয়ার প্রবণতা শিশু মনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন মনোবিশ্লেষক ডা. মোহিত কামাল। তার মতে, শিশুরা ভয় পেয়ে যায় যে অন্যরাতো প্রশ্ন পেয়ে তার চেয়ে ভালো করছে। এতে করে শিশুদের আত্মবিশ্বাস ও মনোসংযোগে ঘাটতি দেখা দেয়। তখনই ওই শিশু প্রশ্ন পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আর যারা পায় না তারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। আর যারা ফাঁস করা প্রশ্ন পেয়েছে তাদের মধ্যে একটি চোর চোর ভাব থাকবে। এভাবেই বাচ্চারা মনস্তাত্ত্বিকভাকে ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে। এভাবেই আমরা শিশুদের ভুল পথে ঠেলে দিচ্ছি। তিনি বলেন, আমার সন্তানকে ভালো করতে হবে, গোল্ডেন প্লাস পেতে হবে- এই যে প্রবণতা অনেকের মনে ঢুকেছে এর জন্য আমি কাকে দায়ী করবো? সমাজকে দায়ী করবো? না কি যারা এই প্রশ্ন ফাঁসের মতো অপকর্ম করছে তাদের দায়ী করবো। কিন্তু অপরাধীরাতো পার পেয়ে যাচ্ছে। ডা. মোহিত কামাল আরো বলেন, প্রশ্ন ফাঁস হলে বাচ্চারা পরীক্ষার আগের দিন বাসায় বসে এর সমাধান করছে। সেজন্য বাচ্চাদের আমরা অপরাধী ভাবছি। কিন্তু আমি মোটেও বাচ্চাদের অপরাধী ভাবছি না। আমি ভাবছি তাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। কারণ তারা অনৈতিকভাবে উপরে ওঠতে চায়। তাই যে কারণে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে সেই শিকড়টা উপড়ে ফেলতে হবে। ডা. মোহিত কামাল বলেন, যারা প্রশ্ন ফাঁস করছে তারা মহা অনৈতিক কাজ করছে। তারা অপরাধী, খুনি। এভাবে তারা শিশুদের ভবিষ্যৎকেই খুন করছে। আগে ওই অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলনও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অভিভাবকরা যখন চিন্তা করে তার সন্তান প্রতিযোগিতায় টিকবে কি টিকবে না, তখন সন্তানের মঙ্গলের চিন্তায় সামাজিক আন্দোলনও খর্ব হয়ে যায়।
আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে প্রাথমিক সমাপণী পরীক্ষা। এ পরীক্ষাতেও কি এ প্রশ্ন ফাঁসের উৎসব হবে সে প্রশ্ন এরই মধ্যে উঠেছে। বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বিষয়ের পরীক্ষায় শেষ হয় এবারের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট-জেএসসি পরীক্ষা। যথারীতি এ দিনও পরীক্ষার ঘণ্টাখানেক আগে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। অনেক অভিভাবক আর শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায় প্রশ্ন। রাজধানীর বেশ কিছু পরীক্ষার কেন্দ্রের সামনে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র মেলাতে দেখা যায়। অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেছেন, তারা চেষ্টা করছেন প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে, কিন্তু পারছেন না। বৃহস্পতিবার সকালে মিরপুরের এম ডি সি মডেল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পৌনে ৯টার পর থেকেই শিক্ষার্থীরা জটলা করে কেন্দ্রের বাইরে মোবাইল ফোনে প্রশ্ন ও তার উত্তর দেখছেন। সেখানে ‘খ’ সেটের ‘দিকপাল’ প্রশ্নটি মোবাইলে পড়ছিলেন এক শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে কথা বললে তিনি প্রশ্ন পাওয়ার কথা স্বীকার করেন।
সুলতান মোল্লা স্কুলের আরেক শিক্ষার্থী তার বোনের পাশে দাঁড়িয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন-উত্তরে চোখ বুলাচ্ছিলেন। তিনি প্রশ্নের একটি কপি শেয়ার ইটে এ প্রতিবেদককে দেন। এই শিক্ষার্থী জানান, তার দুলাভাই তাকে আগে বলে রেখেছিলেন প্রশ্ন পাবেন। তিনি ৯টার কয়েক মিনিট পর একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে প্রশ্নটি সংগ্রহ করে তাকে পাঠিয়েছেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে অভিভাবকদের এই সহযোগিতার দৃশ্য দেখা গেছে কেন্দ্রের সামনেও। এ কেন্দ্রের এক শিক্ষার্থী পরীক্ষার সময় হয়ে গেছে বলে দ্রুত পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকতে চাইলে তার মা তাকে পরে ঢুকতে বলেন। সন্তানকে তিনি বলেন, এখন ভালো করে প্রশ্নের উত্তরগুলো পড়ে নাও। ৫ মিনিট আগে ঢুকলেই হবে।
এ প্রশ্ন যদি পরীক্ষায় না আসে তখন কী করবেন-এ প্রশ্নের জবাবে ওই শিক্ষার্থী বলে, সকালে যে প্রশ্নটা পাই সেটাই তো আসে। সব পরীক্ষায় সকালে যে প্রশ্নটা পেয়েছি, সেটাই এসেছে। আর ‘খ’ সেটের ‘দিকপাল’ প্রশ্নটি ৪-৫টা পরীক্ষায় এসেছে। এটা আসবে নিশ্চিত। সকালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রের সামনেও জটলা করে শিক্ষার্থীদের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও উত্তর পড়তে দেখা যায়। সাড়ে ৯টার দিকে ফেসবুক মেসেঞ্জার আর হোয়াটস অ্যাপে ইমেজ আকারে ‘খ’ সেট ‘দিকপাল’ নামে বোর্ড প্রশ্নের একটি সেট আসে, তার সঙ্গে হাতে লেখা বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তরও পায় শিক্ষার্থীরা। ওই প্রশ্ন-উত্তর নিয়ে ব্যস্ত শিক্ষার্থীদের একজনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যারা প্রশ্ন পায় তারা পরীক্ষার হলে কখন ঢোকে? জবাবে তিনি বলেন, “যারা প্রশ্ন পায় তারা পরীক্ষার পাঁচ মিনিট আগে ঢোকে, যারা পায় না তারা আরো আগেই ঢুকে যায়। প্রশ্ন পেয়ে উত্তর পড়ে তারপর ঢোকে, তাই ওরা পাঁচ মিনিট আগে ঢোকে। সব প্রশ্নই (পরীক্ষার) আগে পাওয়া গেছে।” ছেলে এত দেরিতে পরীক্ষার কেন্দ্রে যাচ্ছে কেন- এ প্রশ্নের জবাবে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের এক শিক্ষার্থীর মা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমসিকিউয়ের উত্তর দেখে যাচ্ছে। সাংবাদিক বুঝতে পেরে তিনি বলেন, “রিভিশন করছে।” দুপুর ১টায় পরীক্ষা শেষ হলে মতিঝিল মডেল হাই স্কুলের এক পরীক্ষার্থী জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় তারা যে প্রশ্ন পেয়েছিলেন ‘খ’ সেটের, সেটিই হুবহু এসেছে মূল পরীক্ষায়, বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর সবক’টি সঠিক হয়েছে তার। একই কথা বলেন আরো কয়েকজন পরীক্ষার্থী।
প্রশ্নের জন্য যে টাকা দিতে হয় তা কোথায় পান- এই প্রশ্নের উত্তরে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলের এক পরীক্ষার্থী বলে, তারা চার-পাঁচজন বন্ধু মিলে টাকা দিয়ে প্রশ্ন কেনেন, তারপর অন্য বন্ধুদেরও দেন। “প্রশ্নের টাকা তো একা দিতে পারি না। একজন যোগাযোগ করে প্রশ্ন নেই তারপর চার-পাঁচ জন মিলে টাকা দিই। বাসা থেকে নিই টাকা।” সকালে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের অনুলিপি দেখে ৯টা ৫৮ মিনিটে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকারকে বিষয়টি জানানো হয়। তখন তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষা শেষ হলে দেখা যাক, ওই সেট পরীক্ষায় এসেছে কি না।” পরে পরীক্ষা শেষে বেলা দেড়টার দিকে তাকে ফোন করে ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই পরীক্ষা হওয়ার কথা জানালে দৃশ্যত অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তিনি। “আমরা চেষ্টা করছি এটা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু আমারও প্রশ্ন, এটি বন্ধ হচ্ছে না কেন?” প্রশ্ন ফাঁস রোধে অভিভাবকদের সচেতনতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।