র্যাব রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে অভিনব পন্থায় বিদেশে মাদক পাচারকারী আন্তর্জাতিক চক্রের দেশীয় মূল হোতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে । তারা হলেন- মীর মঞ্জুর মোর্শেদ (সানী), মো. মাহমুদুল হাসান (চয়ন) এবং মো. হাবিবুল্লাহ খান।
সোমবার বিকালে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৪৫টি লেভেলযুক্ত বোতলে রক্ষিত (প্রতি বোতলে ১০ মি. লিটার) ১.৪৫০ লিটার জি কেটামিন, ৩৪টি সাদা তোয়ালে (প্রতিটি তোয়ালেতে ১০০ গ্রাম) তিন কেজি চারশ গ্রাম জি কেটামিন, ১৮০টি জি কেটামিনের খালি বোতল, পাঁচটি তোয়ালে ও অন্যান্য সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত ৩৪টি কিটোমিন যুক্ত তোয়ালের মধ্যে ১৮টি তোয়ালে একটি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে উদ্ধার করা হয়।
মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে রাজধানীর কাওরানবাজারে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখায় এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।
সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, র্যাব জানতে পারে যে, একটি আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্র অভিনব কৌশলে বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে মাদকদ্রব্য চোরাচালান করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-১ এর একটি দল রুপনগর থানার পল্লবী দ্বিতীয় পর্বের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের সি ব্লকের ১৮৭ নম্বর বাড়ির তিন তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে সোমবার বিকাল পাঁচটার দিকে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের তিনজন সক্রিয় সদস্যদেরকে গ্রেপ্তার করে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, গ্রেপ্তারকৃত মীর মঞ্জুর মোর্শেদ (সানী) পেশায় একজন খামার ব্যবসায়ী। তিনি ছয় থেকে সাত বছর লন্ডনে থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। অন্যদিকে গ্রেপ্তারকৃত মো. মাহমুদুল হাসান (চয়ন) এলএলবি অনার্স এবং গ্রেপ্তারকৃত মো. হাবিবুল্লাহ খান এমবিএ সম্পন্ন করে উভয়ে একটি ব্যাংকের মার্কেটিং শাখায় কর্মরত রয়েছেন। তারা স্ব স্ব ব্যবসা ও চাকরির অন্তরালে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান যে, তারা গত চার থেকে পাঁচ মাস ধরে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্পেনে কেটোমিন মাদক পাচারের লক্ষে সংঘবদ্ধ হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত মীর মঞ্জুর মোর্শেদ সানীর ভাই মাহাদী মঞ্জুর মান্না প্রায় ১৫ বছর ধরে স্পেনে অবস্থান করছেন। তিনি স্পেনে ইন্টারনেট কলিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ব্যবসায়িক সূত্রে তার সাথে স্পেনের এক নাগরিক আরামডো গঞ্জালিওয়ের সাথে পরিচয় হয়। পরবর্তী সময়ে দুজন একত্রে বাংলাদেশ থেকে কিটোমিন স্পেনে পাচার করার পরিকল্পনা করেন। এই লক্ষে মাহাদী মঞ্জুর মান্না চার মাস আগে প্রাথমিক বাজার যাচাই করতে বাংলাদেশ আসেন। তারা স্পেনে ফেরত গিয়ে ওই স্পেনের নাগরিককে বিস্তারিত জানায়। পরবর্তী সময়ে দুই মাস আগে মীর মঞ্জুর মোর্শেদ সানীর ভাই মাহাদী মঞ্জুর মান্নাসহ ওই স্পেনের নাগরিক বাংলাদেশে এসে গ্রেপ্তরকৃতদের হাতে কলমে কিটোমিন মাদক পাচারে প্রস্তুত প্রণালী শিখিয়ে দেন। কিটোমিন মাদক চোরাচালানের জন্য প্রস্তুত করতে বর্ণিত ঠিকানা চিলেকোঠার দুইটি রুম ব্যবহার করত। ওই বাড়িটির চতুর্থ তলায় সানী স্বপরিবারে থাকতেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা র্যাবকে জানিয়েছেন যে, জি-কেটামিন নামক নিষিদ্ধ এই মাদকটি দেশের বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে সংগ্রহ করতেন। প্রস্তুতের জন্য প্রথমে তারা ১০ মি.লি. এর ১০০টি বোতলের ছিপি খুলে রেখে দিতেন যাতে বিষাক্ত গ্যাসটি বের হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে তারা স্টিলের বোলে, হাড়িতে আধাঘণ্টা ধরে জি কেটামিন ইঞ্জেকশনটি উত্তপ্ত করেন। যাতে দ্রব্যটি ঘনরূপ ধারণ করে। এই অবস্থাতেই উত্তপ্ত মাদকটি পরিষ্কার সাদা তোয়ালের এক পাশে স্প্রে করতে থাকেন এবং শুকানোর জন্য রেখে দেন। পরে তোয়ালেগুলো ভাজ করে সুরক্ষিতভাবে প্যাকেটের ভেতরে সিল করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে স্পেনের ঠিকানায় পাঠিয়েছেন। মাদকদ্রব্যটি বিদেশে পৌঁছানোর পরে গ্রেপ্তারকৃত সানীর ভাই মাহাদী মঞ্জুর মান্নাসহ স্পেনের নাগরিক আরামডো গঞ্জালিওর তত্ত্বাবধানে ওই তোয়ালে থেকে মাদকদ্রব্যটি সংগ্রহের কাজটি করা হয়। এই চক্রটি বিগত দুই মাসে চারটি চালান স্পেনে পাঠিয়েছে বলে র্যাবের কাছে স্বীকার করেছেন। জানা যায়, সম্প্রতি বর্ণিত জি-কিটোমিন মাদকদ্রব্যটির চাহিদা ইউরোপিয়ান দেশে হেরোইন অথবা কোকেনের চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
র্যাব জানিয়েছে, র্যাব প্রতিষ্ঠা থেকে এই পর্যন্ত তিন হাজার ২৮৯ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারসহ চার লাখ ৮১ হাজার ৮৭৪ কেজি হেরোইন, দুই কোটি ২৬ লাখ আট হাজার ৯৩ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ২৯ কেজি ৪৯ গ্রাম কোকেন, ২৫ কেজি ৬২৯ গ্রাম আফিম, ২৯ লাখ ৯৫ হাজার ২৩৫ বোতল ফেনসিডিল, তিন লাখ ৭৩ হাজার ৬২৫ ক্যান বিয়ার, এবং ৭৩ হাজার ৪৯১ কেজি গাঁজা উদ্ধার করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানা থেকে পাঁচ কেজি হেরোইনসহ একজনকে গ্রেপ্তার, খুলনা মহানগর থেকে দুই কেজি ২৫০ গ্রাম কোকেনসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার এবং কক্সবাজার থেকে আট লাখ পিস ইয়াবাসহ তিনজন মায়ানমার নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপ পরিচালক মেজর রইছুল আযম মনি, জেষ্ঠ্য সহকারী পরিচালক মো. মিজানুর রহমান ভূঁঞা, র্যাব- ১ অপারেশন ও গণমাধ্যম কর্মকর্তা সামিরা সুলতানা এবং সহকারী পুলিশ সুপার মুহিত কবির সেরনিয়াবাত।