ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ফাঁদ মামলা আতঙ্কে । সাম্প্রতিক সময়ে দুদক বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে ফাঁদ পেতে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে আটক করেছে। পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়। দুদকের এই ফাঁদ মামলা ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এখন রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের হাতেনাতে আটকের পর ঘুষখোর কর্মকর্তারা ভয়ে দিন পার করছেন। কেউ কেউ আপাতত ঘুষ নেয়া বন্ধ করেছেন।
আবার কেউ কেউ ঘুষ নেয়ার কৌশলও পাল্টাচ্ছেন। দুদক সূত্রে
জানা যায়, ২০১৪ সালে ফাঁদ মামলার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপর ওই বছরই ফাঁদ মামলা করা হয় ৫টি। ২০১৫ সালে মামলার সংখ্যা কমে হয় ৩টি। পরে কমিশনের কড়া নির্দেশে ২০১৬ সালে ১৩টি ফাঁদ মামলা করা হয়। আর ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত করা হয় ১৮টি। চার বছরে মোট করা হয় ৩৯টি মামলা। এই ৩৯ মামলার অর্ধেক মামলা করা হয় ২০১৭ সালের ১০ মাসে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুরুর দিকে ফাঁদ মামলাটি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। অনেকটা কচ্ছপ গতিতে এর কার্যক্রম চলতে থাকে। চলতি বছরের শুরুর দিকে দুদক চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থাকে ঘুষ গ্রহণ না করার অনুরোধ জানান। তা না হলে কঠিন পরিণতি হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন। একই সঙ্গে চেয়ারম্যান কমিশনের কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশ দেন। এরপর থেকে কিছুদিন ধরে ফাঁদ মামলার কার্যক্রম দৃশ্যত হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-সহকারি পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য দুদক কর্মকর্তারা ফাঁদ পেতে তাদের আটক করে। বিভিন্ন সময় হাতেনাতে আটক করার ফলে এখন ঘুষখোর অনেক কর্মকর্তা ঘুষ নেয়া বন্ধ করেছেন। তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা যদি দুদকে এসে অভিযোগ করে তবেই আমরা একটি টিম গঠন করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আটকের জন্য একটি ফাঁদ তৈরি করি। তখন ফাঁদ পেতে হাতেনাতে গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত কোনো সেবা প্রতিষ্ঠানকারী সংস্থার কর্মকর্তা কর্তৃক যদি সেবাগ্রহীতা হয়রানির শিকার হন। সেবাদাতা যদি সেবাগ্রহীতার কাছে ঘুষ দাবি করেন এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তি যদি দুদকে অভিযোগ করেন এক্ষেত্রে দুদকের ফাঁদ মামলা করা হয়। মূলত দুর্নীতি দমন কমিশন ভুক্তভোগীর সঠিক অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে। তদন্তে যদি অভিযুক্তকারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায় তবে কমিশন মামলার অনুমোদন দেয়। কিন্তু সরকারি ঘুষখোর কর্মকর্তাদের হাতেনাতে ধরার জন্য ফাঁদ পাতা হয়। এক্ষেত্রে আসামিকে হাতেনাতে আটক করার জন্য অভিযোগকারী ব্যক্তিই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। দুদক বলছে, তারা ফাঁদ মামলার মাধ্যমে ঘুষের লাগাম টানতে চায়। এজন্য দুদকের চেয়ারম্যান ঘুষ দেয়ার আগে ঘুষ গ্রহণকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। দুদকের মহাপরিচালক (লিগ্যাল অনুবিভাগ) মো. মাইনুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ফাঁদ মামলায় ঘুষ নেয়ার সময় যাদের হাতেনাতে আটক করা হয় তাদের বিরুদ্ধে শক্ত চার্জশিট দেয়া হয়। তবে কিছু কিছু মামলা বিচারিক আদালত থেকে উচ্চ আদালতে গেলে আসামি অনেক সময় খালাস পেয়ে যায়। তবে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার মামলায় সাজা অনেকটা নিশ্চিত।
২০১৬ সালের মে মাসে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার পঞ্চগ্রাম সম্মিলনী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রনজিৎ কুমার বৈরাগির কাছ থেকে ২ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণকালে আটক হন শিক্ষা ভবনের সহকারী পরিচালক (পরিদর্শন ও নিরীক্ষা) মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় তার কাছে আরো নগদ ৯৮ হাজার টাকা পাওয়া যায়। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে এসব টাকার কোনো বৈধপন্থা দেখাতে না পারার জন্য পল্টন মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। চলতি বছরের ১৮ই জুলাই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রকৌশলী ও শিপ সার্ভেয়ার একে এম ফখরুল ইসলামকে ৫ লাখ ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে দুদকের একটি টিম। পরে মতিঝিল থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। গত ১৩ই সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. জাকির হোসেনকে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণকালে গ্রেপ্তার করে দুদক। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় মামলা করা হয়। পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স দেয়ার কথা বলে বিআরটিএর নরসিংদী কার্যালয়ের কর্মকর্তা সুমন কুমার সাহা ইয়াছিন আরাফাত নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। ১৪ই সেপ্টেম্বর তাকে হাতেনাতে আটক করে নরসিংদী থানায় মামলা করা হয়। ব্রান্সডকের প্রশাসন শাখার কর্মচারী মো. শহিদুল্লাহ একই অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন কাটার ভয় দেখিয়ে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। পরে সেদিনই দুদকের একটি টিম তার অফিস থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে শেরেবাংলা থানায় একটি মামলা করেন। ১৩ই সেপ্টেম্বর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্বামী-স্ত্রীকে চাকরি দেয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেয়ার সময় ফাঁদ পেতে দুদকের একটি টিম হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অফিস সহায়ক মো. সুলতান হোসেন তালুকদারকে। পরে মিরপুর শাহ আলী থানায় ঘুষ নেয়ার অপরাধে একটি মামলা করা হয়।