মিয়ানমারের মংডুর রোহিঙ্গারা এবার দেশ ছাড়ছেন । মংডু ও বুচিডং এ দুই টাউনশীপ নিয়ে মংডু জেলা গঠিত। আরাকানের (সংশোধিত নাম রাখাইন স্টেট) ৪টি জেলার মধ্যে আকিয়াবের পর মংডুর স্থান। ২টি থানা নিয়ে গঠিত হলেও আরাকান রাজ্যের অন্যতম বৃহত্তর ও সমৃদ্ধশালী জেলা হচ্ছে মংডু। মংডু থানাধীন মুসলিম অধ্যুষিত ১০৫টি ইউনিয়নের রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সেনা এবং মগদের বহুমুখী নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসলেও মংডু শহরের আশপাশের গ্রামে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে নাড়িকাটা মাতৃভুমি ছেড়ে আসেননি। এদের বেশীর ভাগই অবস্থা সম্পন্ন পরিবার এবং ব্যবসায়ী। শখের বসতবাড়িটি পুড়িয়ে না দিতে দাবি মতো লক্ষ লক্ষ কিয়াট ঘুষ দিয়েও মন ভরছেনা মগ-সেনাদের। অনেক মুসলমান পরিবার আছেন স্থাবর-অস্থাবর বিশাল সম্পদের মালিক। আর কিছু আছেন সরকারী ও বেসরকারী চাকরীজীবি। এদের সংখ্যাও নেয়ায়েত কম নয়। মিয়ানমার সেনা এবং মগরা এখন তাঁদের উপর চড়াও হয়েছে ও হচ্ছে বলে জানা গেছে। সেই সম্পদের উপর লোলুপ নজর পড়েছে মগ-সেনাদের।
জানা যায়, মংডু ও বুচিডং এ দুই টাউনশীপই সব চেয়ে বৃহৎ এবং মুসলিম অধ্যুষিত। মংডু থানা বা টাউনশীপের আওতায় ইউনিয়ন (তাঁদের ভাষায় ‘গোয়াইং’) আছে ১০৫টি। বুচিডং থানা বা টাউনশীপের আওতায় ইউনিয়ন (তাঁদের ভাষায় ‘গোয়াইং’) আছে ৮৫টি। পুরো আরাকানে রয়েছে ৪টি জেলা এবং ১৭টি টাউনশীপ বা থানা। ৭টি থানা বা টাউনশীপ নিয়ে গঠিত আকিয়াব (নতুন নাম সিটওয়ে) জেলায় মুসলমানদের সংখ্যা বেশী। আকিয়াব জেলার থানাগুলো হচ্ছে আকিয়াব, রাচিডং, পুঁংনাজুঁেয়, কিয়ট্র, পাত্তরিকিল্লা, মামব্রা, পকট। ২০১৬ সালের অক্টোবরে আকিয়াব জেলায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনায় ৭টি থানা থেকেই ছোট ছোট দলে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। যার সংখ্যা ছিল ২ লক্ষাধিক। কক্সবাজার এবং পার্বত্য জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এরা বসবাস করছে। বাকি যাঁরা ছিলেন এখন আসছেন।
মংডু সদর থানার ১০৫টি, বুচিডং থানার ৮৫টি এবং আকিয়াব জেলার ৭টি থানার ২ শতাধিক ইউনিয়ন থেকেই এবারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নেমেছিল। আকিয়াব মুলতঃ একটি দ্বীপ। ছোট ছোট আয়তণ নিয়ে থানাগুলো গঠিত। তাছাড়া আকিয়াব ও মংডু বন্দর শহর।
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যটি উত্তর-দক্ষিণ লম্বা। বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনদ্বীপের সোজা পুর্বে ওপারে সীতাপুরিক্ষা, শাহপরীরদ্বীপের সোজা ওপারে হাইচ্ছুরাতা, টেকনাফের সোজা ওপারে মংডুর সুধাপাড়া এবং হ্নীলার সোজা ওপারে নাকপুরা। বাংলাদেশের উখিয়া উপজেলার পালংখালী, থাইংখালী, বালুখালীর উত্তরে পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্ত পয়েন্টটি একেবারে কাছাকাছি। সামান্য পানি এবং পায়ে হেঁটে পারাপার হওয়া যায়।
এখন আসছেন মংডু শহরের কাছাকাছি গ্রামের রোহিঙ্গা। এরা বড়ছড়া, আংঢাং, কুল্লুং, সীতাপুরিক্ষা, চব্রেড, মেরুল্লা, ঘরাখালী, উধং, খইজ্জ্যারবিল, হাইচ্ছুরাতা, সনখদ্দারবিল, শীলখালী, হঁরছড়া, লম্বাঘুনা, ঘুনাপাড়া, চাইরকম্বু, গদুছড়া, নয়াপাড়া, ধাওনখালী, শাইরাপাড়া, চাইন্দাপাড়া, বাঘঘুনা, কাজিরবিল, নলবনিয়া, বড়ডেইল, খাইন্দাপাড়া, সিকদারপাড়া, হেতাইল্যা, উকিলপাড়া, খাঁরিপাড়া, মাংগালা, বমুপাড়া, নাইতারডেইল, চাইরমাইল, খইল্যাভাঙ্গা, কাউয়ারবিল, জামবইন্যা, বকসুপাড়া, আশিক্যাপাড়া, সুদাপাড়া, মগনামা, নারীবিল, নন্দাখালী, সংখদ্দাবিল, দারোগাপাড়া, পেরামপ্রু, ছ্ােট গউজবিল, খোলারবিল, চালিপ্রাং, প’খালী, জামবইন্যা, রাঙ্গাবালি, বড় গউজবিল, রইগ্যাদং, রাইম্যারবিল, কাইমপ্রাং, বুড়া সিকদারপাড়া, রাইম্যাদং, কিয়ারিপ্রাং, নাইংচং, নাইচাপ্রু, লুদাইং ইত্যাদি এলাকার রোহিঙ্গা। তাঁদের জন্য বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের বেশী সুবিধাজনক পয়েন্ট ছিল শাহপরীরদ্বীপ ও টেকনাফ।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, কষ্ট হলেও আমরা স্বদেশে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্ত নিত্য-নতুন মগ-সেনাদের চাহিদা, আবদার, তাড়ানোর কৌশল, নির্যাতন বাড়ছে। মগ-সেনাদের মনোভাব বুঝাও মুশকিল। একবার বলে থাকতে, আবার বলে চলে যেতে। পুরানো আমলের পরিচয়পত্র কেড়ে নিচ্ছে। হাটবাজার, মুসলমানদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্দ। অবরুদ্ধ অবস্থা। তীব্র খাবার সংকট।
মংডু এবং মংডুর আশপাশের গ্রাম থেকে শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং ও টেকনাফ কাছে হলেও দীর্ঘ নৌপথ পাড়ি দিয়ে উখিয়া উপজেলার পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করার কারণ জানতে চাইলে ছাতা মাথায় শিশু সন্তানসহ কোমর পানি অতিক্রম করে বাংলাদেশ পানে ছুটে আসা মংডু কাজিরবিল আবদুল হাকিমের স্ত্রী আসমা আক্তার (২০) বলেন ‘মংডু থেকে শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং ও টেকনাফ কাছে হলেও যাওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে খুব কড়াকড়ি চলছে বলে শুনেছি। কোন নৌকার মাঝি সেদিকে যেতে রাজি হয়না। তাই ভাড়া বেশী দিয়ে হলেও এদিকে চলে এসেছি। তাছাড়া এখান থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প খুবই কাছে। শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং ও টেকনাফ হয়ে আসলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পর্যন্ত পৌছতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। মিয়ানমারের মংডু এবং মংডুর দক্ষিণে আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছে’।
গত কিছু দিন ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্দ থাকলেও উখিয়া-টেকনাফে বিশেষতঃ উখিয়া সীমান্তে আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নেমেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতায় সীমান্ত পেরিয়ে আবারও প্রতিদিন বাংলাদেশে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। এখন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, তাজনিম্যারখোলা পাহাড়, পালংখালী বাঘঘোনা পাহাড়, টেকনাফের চাকমারকুল, পুটিবনিয়া, লেদা, নয়াপাড়া, শামলাপুর এবং ঘুমধুম তুমব্রু সীমান্ত এলাকায়।
বনবিভাগের জায়গার উপর সমাজিক বনায়ন কেটে রাতারাতি নতুন বস্তি গড়ে তুলছে রোহিঙ্গারা। উক্ত বস্তি গুলোতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসা অব্যাহত থাকায় ক্যাম্পগুলোয় স্থান সংকুলান হচ্ছেনা বলে জানা গেছে। ফলে ক্যাম্পে ঠাঁই মিলছে না অধিকাংশের। তারা রাস্তা-ঘাট, দোকান-পাটসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে। এককথায় রোহিঙ্গা ভারে নুয়্যে পড়েছে উখিয়া-টেকনাফ।
বুধবার ১৮ অক্টোবর দুপুরে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরে জানা গেছে সীমান্তের ওপারে এখনও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য অপেক্ষায় আছে। রোহিঙ্গারা জানান গত কয়েক দিনে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। তাছাড়া মিয়ানমারের ‘পুরমা’ খালের পাড়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। নদীতে পাহাড়ী ঢলের ¯্রােত থাকার কারনে তারা নদী পার হয়ে আসতে পারছেনা। সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা খুবই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্য ও পানি সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারী-বেসরকারীভাবে শুকনো খাবার, পানি, ত্রিপল দেয়া হলেও তাতে সংকুলান হচ্ছেনা। বৃষ্টিতে এবং স্যানিটেশন নিয়ে রোহিঙ্গাদের কাহিল অবস্থা চলছে।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |