তাহমিনা খাতুন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালক। বর্তমানে সিলেট বিভাগের দায়িত্বে। গত জানুয়ারি মাসে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত শেয়ার শিক্ষা কর্মসূচির অন্যতম ইউনিক-২ প্রকল্পের এনুয়াল রিভিউ অ্যান্ড প্ল্যানিং ওয়ার্কশপে ‘সম্মানিত অতিথি’ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। শ্রীমঙ্গলে অনুষ্ঠিত সেই কর্মশালা চলাকালীন সময়ে সিলেটে বিভাগে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম, প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে এনজিওদের ভূমিকা, সরকার ও এনজিওদের কাজের সমন্বয়ের উপায়, কীভাবে এনজিওদের শিক্ষা কার্যক্রম টেকসই করা যায় ইত্যাদি নানান বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন শেয়ার শিক্ষা কর্মসূচির টেকনিক্যাল টিমের সদস্য মোহাম্মদ গোলাম নবী ইন্টারভিউয়ের বক্তব্য ও বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনুধাবন করে রেকর্ডেড ইন্টারভিউয়ের পুরোটাই প্রকাশ করা হলো। এই ইন্টারভিউ প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত সরকারি বেসরকারি সকল পক্ষকে চিন্তার সূত্র দেবে। বিশেষ করে এনজিওরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে এই ইন্টারভিউ থেকে দিক নির্দেশনা পাবেন।

প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে এনজিও স্কুলের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা? যদি থাকে তাহলে কীভাবে এনজিওরা এই কার্যক্রমে আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে পারে?

আমি সিলেটে আছি প্রায় তিন বছর ধরে। সিলেট বিভাগ নানা বৈচিত্র্যে ভরা। এটা দেশের অন্য বিভাগগুলোর মতো নয়। সিলেটে হাওর আছে, পাহাড় টিলা আছে আবার চা বাগান আছে। ভৌগোলিক বিচিত্রতার কারণেই এখানকার মানুষ ও তাদের জীবনযাপনও বৈচিত্র্যময়।

প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সিলেট বিভাগের দায়িত্ব পালন করায় আমাকে পুরো সিলেটই ঘুরে দেখতে হয়। এখনো সিলেটে পর্যাপ্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। যেমন চা বাগানের অনেক জায়গায় সরকারি স্কুল নেই। আবার হাওর এলাকার স্কুলগুলো বর্ষাকালে বেশিরভাগ শিশুর নাগালে বাইরে চলে যায়। ফলে অনুপস্থিতি বেড়ে যায়। ভৌগোলিক কারণে শুকনো মৌসুমেও সব শিশুর পক্ষে স্কুলে যাওয়া সহজ হয় না। এই অবস্থায় ৪/৫ বছরের শিশুদের সরকারি স্কুলে নিয়ে আসা সরকারের জন্য অনেক কঠিন কাজ। যারা একটু বড় তারা নৌকায় কিংবা পায়ে হেঁটে দূরের স্কুলে যেতে পারলেও প্রি-প্রাইমারি বা গ্রেড ওয়ান টু-র শিশুদের পক্ষে দূরের স্কুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এই অবস্থায় ছোট শিশুদের জীবনের প্রথম কয়েক বছরের লেখাপড়ায় এনজিওসহ সকলের সহযোগিতা দরকার।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলছেন দেশটা সকলের ফলে সরকার একা সব কিছু করতে পারবে না সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু দেশটা আমাদের সকলের এবং প্রত্যেক শিশুর অধিকার আছে লেখাপড়া করার সেকারণে আমরা সরকারিভাবে যেখানে পৌঁছাতে পারিনি কিংবা পৌঁছানো কঠিন সেখানে এনজিওসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এগিয়ে আসতে পারেন। অনেকক্ষেত্রে তারা এগিয়ে এসেছেনও।

আরেকটি কথা হলো আমাদের অনেক জায়গায় স্কুল থাকলেও পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। সিলেটের দুর্গম এলাকায় শিক্ষকের নিয়মিত উপস্থিতি কঠিন হয়। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সিলেটে কমিউনিটির লোকজন নিজ নিজ কমিউনিটি থেকে শিক্ষক দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছেন। এই ধরনের শিক্ষককে প্যারা টিচার বলা হয়। সত্যি বলতে কি এই প্যারা শিক্ষক না হলে ওই স্কুলগুলো সারাবছর ধরে চালানো হয়তো সম্ভব হতো না।

কিছুদিন আগে আমি জৈন্তাতে গিয়েছিলাম। সেখানে এমন অনেক গ্রাম পেলাম যেখানে কাছে ধারে স্কুল নেই। সেখানে আমি ব্র্যাকের স্কুল দেখেছি। এলাকার লোকজন আলাপকালে বলেছেন যে, ব্র্যাকের স্কুল না হলে তাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে পারত না। সেখানে ব্র্যাক স্কুলের ছেলেমেয়েরা প্রি-প্রাইমারি ও গ্রেড ওয়ানে বা টু-তে পড়ছে। আমার মনে হয়েছে এরপর এই বাচ্চারা কোথায় পড়তে যাবে? তারা কী ওখান থেকে দেড় দুই মাইল দূরের স্কুলে পড়তে যেতে পারবে?

সেক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী? এনজিওরা প্রিপ্রাইমারি থেকে গ্রেড টু পর্যন্ত কমিউনিটিতে লেখাপড়া করাবে, তারপর শিক্ষার্থীরা একটু বড় হয়ে সরকারি স্কুলে যাবে

দেখুন এখন সরকারি স্কুলেও প্রি-প্রাইমারি আছে। সেখানে আমরা পাঁচ ও পাঁচ বছরের কাছাকাছি বেশি বয়সী শিশুদের ভর্তি করি। আর ছয় বা ছয় বছরের কাছাকাছি বয়সী শিশুদের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। অর্থাৎ এক বছর প্রি-প্রাইমারি পড়ে শিশুরা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। যে শিশুদের বাড়ি সরকারি স্কুলের ধারে কাছে তারা পাঁচ বছর বয়সে সরকারি স্কুলে প্রি-প্রাইমারি পড়তে আসতে পারে। কিন্তু যাদের বাড়ি দূরে তাদের আসার ইচ্ছে থাকলেও তারা আসতে পারে না। এটাই বাস্তবতা। পাশাপাশি এটাও বাস্তবতা হলো যে, সিলেটে এখনও অনেক গ্রাম আছে যেখানে স্কুলই নেই।

আপনার প্রশ্ন হলো এনজিওরা কোন গ্রেড পর্যন্ত স্কুল চালাবে? দেখুন, এর সহজ কোন জবাব নেই। আমি অনেক সময় মাঠ পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছি অষ্টম বা নবম শ্রেণির মেয়েরা হাওরের মধ্যে কোন একটি বিচ্ছিন্ন গ্রামে দাঁড়িয়ে আছে পরীক্ষা দিতে যাবে বলে। আমি তাদেরকে আমার নৌকায় নিতে যেয়ে দেখি তাদের পথ ভিন্ন। তাদেরকে রেখেই আমাকে চলে যেতে হয়। তারা যে নৌকার অপেক্ষায় থাকে, সেই নৌকা আসা মাত্রই কিন্তু সবসময় ছাড়ে না। যাত্রী পাওয়ার পর ছাড়ে। এই অবস্থায় পরীক্ষার্থী ওই ছেলেমেয়েরা নিজেরাও জানে যে, তারা সময়মতো পরীক্ষার হলে গিয়ে পৌঁছাতে পারবে কি না।

ব্যাপারটা খুবই জটিল। একারণে স্থানীয় পর্যায়ের চাহিদা দেখে সেই মোতাবেক পরিকল্পনা করতে হবে। কোথায় এনজিওরা কতগুলো স্কুল করবে বা সেই সব স্কুলে কোন গ্রেড থেকে কোন গ্রেড পর্যন্ত লেখাপড়া করানো হবে সবই নির্ভর করছে স্থানীয় পর্যায়ের চাহিদার উপর। আবার এই চাহিদা বদলাতে পারে। সে কারণে নিয়মতি মনিটরিং ও চাহিদা যাচাই বাছাই করতে হবে। এটা খুবই একটা জটিল প্রক্রিয়া কিন্তু আমরা যদি সব শিশুকে লেখাপড়ার আওতায় আনতে চাই আমাদেরকে এই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যেই যেতে হবে।

তারমানে নির্দিষ্ট কোন সূত্র নেই যে, বলা যাবে এনজিওরা প্রিপ্রাইমারি থেকে গ্রেড টু পর্যন্ত স্কুল করবে কোথাও কোথাও গ্রেড ফাইভ পর্যন্ত হতে পারে কিংবা আরো উচ্চগ্রেডের জন্যও ভাবতে হতে পারে তাই তো?

এখনই তো আছে। যেমন সরকারের উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প রস্কের আওতায় সিলেটে অনেক স্কুল গ্রেড ফাইভ পর্যন্ত চলছে। আমি সেসব স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছি। এছাড়াও এনজিওদের মধ্যে ব্র্যাকের স্কুল, আরডিআরএস-এর শিখন স্কুল আমি দেখেছি। এনজিওদের স্কুল দেখে আমার ভালো লেগেছে। তবে এগুলোকে ঠিক স্কুল বলা যাবে না। শিক্ষাকেন্দ্র বলা যেতে পারে। কারণ একটি স্কুলের যে পরিবেশ ও সংযোগ ঘণ্টা থাকার কথা সেসব এনজিও পরিচালিত শিক্ষাকেন্দ্রে নেই। তবে যে ২৫/৩০ জন বাচ্চা নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছে সেটার প্রশংসা করতে হবে।

কয়েকদিন আগে আমি আরডিআরএস এর একটি শিক্ষাকেন্দ্র (এটি শেয়ার শিক্ষা কর্মসূচির চারটি প্রকল্পের অন্যতম শিখন প্রকল্পের স্কুল) পরিদর্শন করেছি। সেখানের গ্রেড টুয়ের শিশুদের পড়ানো হচ্ছিল। আমি তাদের লেখাপড়ার মানে খুবই সন্তুষ্ট।

একটি বিষয় না বললেই নয়। শিখন স্কুলে গিয়ে আমি দেখেছি প্রতিটি শিশু একইভাবে শিখছে। সরকারি স্কুলে অনেকসময় দেখা যায় যে, একটি ক্লাসের তিন চারটি শিশু অনেক ভালো শেখে কিন্তু বেশিরভাগ শিশু সেই ভাবে শিখতে পারছে না। হয়তো ক্লাসরুমে শিক্ষার্থী শিক্ষক অনুপাত বেশি হওয়া কিংবা অন্য কোন কারণে শিশুদের সবার শেখা সমানভাবে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে যারা ভালো পারে সেটা মূলত শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব। কিন্তু শিখন স্কুলে সব শিক্ষার্থীদের সমানভাবে পারা মূলত শিক্ষকের কৃতিত্ব। শিখন স্কুলের শিক্ষক আন্তরিক বলে তিনি যতোটা নিজে জানেন ও পারেন পুরোটাই শিশুদের সবাইকে শেখাচ্ছেন। জৈন্তার শিখন স্কুলে গিয়ে আমার তেমনটাই মনে হয়েছে।

আর একটি কথা হলো শিখন স্কুলে একটি ক্লাসে ৩০টা শিশু, বিপরীতে আমাদের অনেক সরকারি স্কুলে এখনো ১০০/১৫০টি পর্যন্ত শিশু পড়ে। এমনকি নাম ডাকতে ডাকতেই অনেকটা সময় চলে যায়।

এনজিও স্কুলের শিক্ষার মান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন এই ব্যাপারে আপনার কি মত?

আসলে এটা পুরোপুরি ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার। দেখুন আমাদের সরকারি স্কুলে এখন যে শিক্ষকরা আছেন তাদের বেশিরভাগ মাস্টার্স পাস। কমপক্ষে ডিগ্রি পাস। তারমানে গ্রেড ফাইভে পড়ানোর জন্য একজন শিক্ষকের যে মানের লেখাপড়া জানা দরকার সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা তারে চেয়ে বেশি জানেন। আমি দেখেছি অনেক শিক্ষক আছেন যাদের সরকারি স্কুলে চাকরি নেওয়াটা লক্ষ্য ছিল না, মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি চাকরি। বিসিএস ক্যাডার হওয়া। কিন্তু সেটা না পাওয়ায় ‘আপাতত একটা চাকরিতে ঢুকি’ মানসিকতা থেকে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। ফলে তার মধ্যে প্রতিজ্ঞার ঘাটতি থেকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

একজন যখন ভালো লাগা থেকে শিক্ষক হন কিংবা প্রতিজ্ঞা থেকে শিক্ষকতা করেন তখন তার শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি থাকলেও তিনি সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেন। আমি আমার দেখা থেকে যদি বলি এনজিও স্কুলের শিক্ষকরা খুবই আন্তরিক। তারা নিবেদিত হয়েই শিক্ষকতা করেন। ফলে এনজিও স্কুলের শিক্ষার মান ধরে রাখতে শিক্ষকরা খুবই সচেষ্ট থাকে।

তবে একথাও আমি এখানে বলতে চাই যে, সরকারি স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষক আন্তরিক ও নিজের কাজের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তা না হলে সরকারি স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা এতো ভালো ফলাফল করতে পারত না। আরেকটা কথা এখানে না বললে নয় যে, আমাদের সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের নানান ধরনের সরকারি জরিপের কাজে সম্পৃক্ত হতে হয় এবং ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে তারা যতোটা সময় স্কুলে দেওয়া দরকার সেটা দিতে পারেন না।

মাঠে গেলে এই বিষয়গুলো আমরাও দেখতে পাই শিক্ষকের শূন্যপদের পাশাপাশি তিন জন বা পাঁচ জন শিক্ষকের মধ্যে এক জনের প্রশিক্ষণে যাওয়া, আরেকজনের জরিপের কাজে স্কুলের বাইরে থাকা বা প্রধান শিক্ষকের উপজেলা শিক্ষা অফিসে যাওয়ার কথা শুনতে পাই এই অবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও অনেকসময় এনজিও স্কুলের উপস্থিতিকে স্বাগত জানান আপনিও বললেন যে, কমিউনিটিতে এনজিওদের স্কুলের প্রয়োজনীয়তা আছে এদিকে দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে এনজিওদের শিক্ষা কার্যক্রমে অর্থায়ন কমে আসছে এই অবস্থায় ইতোমধ্যে স্থাপিত এনজিও স্কুলগুলোকে টেকসই করার জন্য কী করা যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

দেখুন, আমাদের সকলের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। মানে সরকার ও এনজিও যারাই স্কুল চালাচ্ছে তাদের লক্ষ্য হলো শিশুদের মানসম্মত লেখাপড়া করানে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে আমাদের দেশ একটাই। এখানে শিশুদের প্রত্যেককেই লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কিন্তু সেসঙ্গে এটাও দেখতে হবে যেন একটা আরেকটার মত না হয়।

অনেক এনজিও এবং সরকারি কিছু কিছু শিক্ষা প্রকল্পে আর্থিক সুবিধা, স্কুলের পোশাক, খাবার ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে। এতে করে একই শিক্ষার্থীর নাম একাধিক জায়গায় নিবন্ধিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এতে সরকারের অর্থের অপচয়ও বাড়ে। এই প্রক্রিয়াতে একটি শিশুর একাধিক নিবন্ধন থাকার কারণে একাধিক সেট বই ছাপান হয়। আরো অনেক রকমের খরচ বাড়তে থাকে। তাছাড়া পরিসংখ্যানগত ভুল তথ্য তৈরি হয়। এই ধরনের বিষয়গুলো আমাদেরকে এড়াতে হবে।

আমি মনে করি স্কুলের চাহিদা থাকলে তহবিল পাওয়াটা খুব কঠিন নয়। আর একটা কথা হলো শিশুদের শেখার জন্য স্কুল ঘণ্টা, একাধিক শিক্ষক থাকা, মাঠ থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। এনজিও শিক্ষাকেন্দ্রে কিন্তু স্কুলের পরিবেশটা থাকে না। সেটা শিখন স্কুল হোক কিংবা ব্র্যাকের স্কুল। এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে।

আপনি একই শিক্ষার্থীর নাম একাধিক জায়গায় নিবন্ধিত হওয়ার কথা বলছেন এমনটা হওয়ার কারণ কি? সমন্বয়ের অভাব?

কিছুটা তো অবশ্যই সমন্বয়ের অভাব। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি শিশুকে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া। ‘ডুপ্লিকেশনে’ মানসম্পন্ন শিক্ষাও ব্যাহত হয়। আর একারণেই আমি স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনার যুক্তি খুঁজে পাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে ‘বটম আপ এপ্রোচের’ পক্ষপাতি। কারণ তাতে চাহিদা মাফিক পরিকল্পনা করা ও সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

পিইডিপি থ্রিতেও কিন্তু ‘লোকাল লেভেল প্ল্যানিং’ আছে। যেমন ‘স্লিপ ফান্ড’। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকসময় জটিলতা হচ্ছে। তারমানে পরিকল্পনা করলেই হবে না, সেটি আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে বাস্তবায়নও করতে হবে। আমি একটা কথা সবসময় বলি, আমাদেরকে নিজের কাছে নিজের জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। আমাদের নিজের কাজ নিজের কাছেই স্বচ্ছ হতে হবে। নিজ নিজ কাজের প্রতি দায়িত্বশীল ও আন্তরিক হতে হবে। সেটা সরকারি স্কুল হোক আর এনজিও ‘শিখন কর্মসূচি’ হোক। তা নাহলে একজন মানুষকে কতোজন কতোবার পাহারা দিয়ে রাখবে?

তাহলে কি আমরা বলতে পারি যে, যেখানে এখনো সরকারি স্কুল পৌঁছাতে পারেনি এমন দুর্গম এলাকা কিংবা জনসংখ্যা বহুল এলাকা যেখানে পর্যাপ্ত সরকারি স্কুল নেই সেখানে এনজিওদের তাদের এক কক্ষের স্কুল দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা চাহিদা পূরণ করা অব্যাহত রাখা দরকার?

অবশ্যই। সরকার জনবহুল এলাকার স্কুলের শিক্ষক ও কক্ষ সংখ্যা বাড়াচ্ছে। তবে যতোদিন পর্যন্ত সরকার দুর্গম এলাকায় পর্যাপ্ত স্কুল করতে পারছে না ততোদিন পর্যন্ত এনজিওরা তো অবশ্যই সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতেই পারে।

শিক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব সমাধান সরকারকেই করতে হবে এনজিও কখনোই চূড়ান্ত সমাধান নয় কিন্তু যতদিন পর্যন্ত সরকার সমাধান করতে না পারছে ততোদিন পর্যন্ত এক ধরনের সহযোগিতা বা যৌথভাবে কাজ করা দরকার, আপনি তো সেটাই বলছেন তাই না? অন্য আরেকটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি পাঁচ বছর আগে যখন শেয়ার শিক্ষা কর্মসূচি চালু হলো, তখন বাংলাদেশে সরকারি হিসেবে কখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি বা স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ লাখ। এখন সেটা না কমে বরং বেড়ে ৫০ লাখের বেশি হয়েছে এদিকে এনজিও স্কুল মূলত প্রকল্পভিত্তিক হওয়ায় যখনই প্রকল্প শেষ হয়ে যায় এনজিও স্কুলগুলোর বেশিরভাগ বন্ধ হয়ে যায় এই অবস্থায় এনজিওদের করণীয় কি হতে পারে? এনজিও এবং সরকারের সহযোগিতার জায়গাগুলো কী হতে পারে এবং কীভাবে হতে পারে?

সরকার ও এনজিওদের সহযোগিতা কিন্তু এখনো হচ্ছে। আগেও ছিল। তবে আমার কেন যেন মনে হয় এটি আরো একটু জোরালো করা দরকার। যেমন তদারকির জায়গায়। এনজিওদের স্কুলগুলো সরকারের দিক থেকে আরো নিবিড়ভাবে তদারকি করা দরকার। এখন কিন্তু উপজেলা শিক্ষা অফিস সেভাবে এনজিওদের স্কুল তদারকি করে না। নানান কারণেই এখন তারা সেটা করতে পারছে না।

আমি ভিন্ন একটি দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এনজিওরা যখন কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যেমন ধরুন শেয়ার শিক্ষা কর্মসূচির চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রায় ১৮টি এনজিও তাদের কর্ম এলাকায় অনেক ধরনের সম্পদের সমাবেশ ঘটিয়েছে শিক্ষক তত্ত্বাবধায়কসহ মাঠ পর্যায়ে মানব সম্পদ উন্নয়ন করেছে, সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকদেরকে সচেতন করে তুলেছে, স্কুল কার্যক্রম জোরদার করতে নিয়মিত তদারকির জন্য অর্থ খরচ করেছে, সবমিলিয়ে শেয়ার কর্মসূচির ক্ষেত্রে ছয় বছরে ৫০০ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে এখন এই প্রকল্প যখন শেষ হবে তখন যে মানবসম্পদ তৈরি হলো স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো, সেসবের আর ধারাবাহিকতা থাকবে না আপনার কাছে আমরা পরামর্শ চাচ্ছি যে, এই প্রক্রিয়াটিকে কীভাবে চালু রাখা যায়

এমডিজির পরে ২০৩০ সাল পর্যন্ত নতুন যে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি ঘোষণা করা হয়েছে সেটা কিন্তু গুণগতমানের শিক্ষা ও টেকসই উন্নয়নকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকার বৈশ্বিক এই ঘোষণার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। ফলে আপনি সরকারের দিক থেকে করেন বা এনজিওদের দিক থেকে করেন আপনাকে ওই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই কাজ করতে হবে।

আমাদের উপবৃত্তি একটি প্রকল্প আছে, আবার ‘সেকেন্ড চান্স’ প্রকল্প আছে এবং আরো আছে ‘রস্ক’ প্রকল্প। এই তিনটি প্রকল্পের উদ্দেশ্য কিন্তু একই। আমাদের শিশুরা যাতে স্কুলে আসে, তারা যেন শিখতে আগ্রহী হয়, পড়াশোনাটা শেখে তার জন্যই তো এই আয়োজন। এই অবস্থায় আলাদা আলাদা এতো প্রকল্প দরকার আছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। কারণ সরকারের লোকবল কম, কিন্তু প্রতিনিয়ত অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য চেয়ে পাঠাচ্ছে। আমি মনে করি এতো প্রকল্প থাকায় শ্রমের অপব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এক একটা প্রকল্প নেওয়া হয় এবং প্রকল্প মেয়াদ শেষে তার কোন খবর থাকে না। আমাদের একটি প্রকল্প ছিল ‘স্টিম প্রজেক্ট’, ‘বটম আপ এপ্রোচেরৎ চমৎকার এই প্রকল্পটি শেষ হওয়ার আমরা এর সুফল ধরে রাখতে পারিনি। দেখা গেলো, এরপর আরো অনেক প্রকল্প এসেছে এবং প্রতিটি প্রকল্প যেখানে শেষ হয় সেখান থেকে সামনে না গিয়ে নতুন করে আবার শুরু করে। ফলে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়ন ধারণা থেকে বের হয়ে এসে রিলে রেসের মতো যেখানে শেষ হবে সেখান থেকে সামনে আগানোর কথা ভাবতে পারতে হবে। তাহলেই একটি টেকসই শিক্ষা কার্যক্রম আমরা পাব। সবসময় লক্ষ্য রাখতে হবে একটি কাজের ফলাফল থেকে যেন আরেকটা কাজ শুরু হয়।

সরকারের সঙ্গে মিলে কাজ করার ক্ষেত্রে রিলে রেসের মতো করে কাজ করা কীভাবে সম্ভব?

আমার নিজের চোখে দেখা প্রতিভা নামে একটি প্রকল্প সিলেটে শিশুদের জন্য খুবই ভালো কাজ করছিল। কিন্তু সেই প্রকল্পটি শেষ হয়ে গেল। যেকোন শিক্ষা প্রকল্প সেটা এনজিওরা বাস্তবায়ন করলেও সরকারের অনুমতি আছে বলেই তো তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে পারে, এখন যখন কোন প্রকল্প বন্ধ হয় তখন মানবসম্পদগুলো নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যায়। সম্পদের অপচয় হয়। আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য যা কাম্য হতে পারে না।

সরকার ও এনজিওদের কোলাবোরেশনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে হবে এবং সেটা হওয়া দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে যাতে করে শুধু তহবিল পাওয়া গেল আর কয়েকদিনের জন্য এনজিওদের কাজে লাগালাম তারপর তাদেরকে ছেড়ে দিলাম ব্যাপারটা যেন তা না হয়।

এছাড়াও শিক্ষাখাতে কর্মরত কর্মীদের জন্য ‘ক্যারিয়ার প্ল্যান’ করতে হবে। একজন মানুষ যাতে তার চাকরির চিন্তা না করে কাজে মনোনিবেশ করতে পারে। দুই দিন পর পর কাজের সন্ধান করতে হলে তো মানসম্পন্ন কাজ পাওয়া যাবে না। আর শিক্ষা তো মানসম্পন্ন না হলে সেই শিক্ষার মূল্য থাকবে না।

দেখুন সরকার এনজিও যেভাবেই দেখি না কেন কাজ একই, শিশু একই, দেশ একই। আমাদেরকে এভাবে বিষয়টাকে দেখতে পারতে হবে। আমাদের কমিটমেন্টের এই জায়গাটায় যদি সবাই একমত হয়ে কাজ করতে পারে তাহলে আমরা একটি উন্নত দেশে অচিরেই পরিণত হতে পারব। পাশাপাশি যে সব এনজিও ‘দুই নম্বরি’ করছে সেগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কোন ধরনের গোঁজামিল দিয়ে আর যাই হোক শিক্ষা বিশেষ করে শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম চলতে পারে না।

দেখুন, এলাকার লোকজন কিন্তু আমাদেরকে দেখছে। আমি বিষয়টিকে সেভাবেও দেখতে চাই। সরকারের কাজ শুধু সরকারি দপ্তরগুলো তদারক করে না, জনগণের কাছেও আমাদেরকে জবাবদিহিতা করতে হয় এবং সেটা সরকারি বিধি মোতাবেকই।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় আমি বলতে চাই যে, আমাদেরকে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে একটি প্রকল্পের যে কাজের জন্য টাকাটা এসেছে সেই কাজে সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা? টেকসই হওয়ার জন্য এই বিষয়টি জরুরি। দেখুন, শিশুদের জন্য আমরা যা করছি সেখানেও গোলমাল থেকে যাচ্ছে। যেমন, এনজিও স্কুলে অনেক সময় শিক্ষা উপকরণ ও স্কুল ড্রেস বিনামূল্যে দেওয়ার পাশাপাশি খাবারও দেওয়া হয়। এতে করে অনেক সময় দেখা যায় পার্শ্ববর্তী সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থী সেখানে চলে যাচ্ছে। তারা ভর্তি করিয়েও নিচ্ছে। অথচ ওই স্কুলটি ওই শিক্ষার্থীর জন্য নয়। এই ধরনের আরো অনেক বিষয় আছে যেগুলোর সমাধান হওয়া দরকার।

দেখুন এই প্রসঙ্গে আমি আরেকটি কথা বলতে চাই। পরিবারগুলোই তো আসল শিক্ষক। আমরা ১০ ভাইবোন। আমাদেরকে আমাদের বাবা শিখিয়েছেন জীবনে সততার মূল্য সবচেয়ে বেশি। আজকে আমরা সবাই কর্মজীবনে আছি। আমার আব্বার গর্ব একটাই, সেটা হলো আমাদের সততা নিয়ে। সবাই সততার সঙ্গে কাজ করছি। নিজের কাছে আমাদের সব ভাইবোন স্বচ্ছতার সঙ্গে জীবনযাপন করছি।

আমার আব্বাও সরকারি চাকরি করতেন এবং তিনি নিজেও সততার সঙ্গে কাজ করেছেন। দেখুন দেশের কে কী করল সেটা আমার দেখার তো দরকার নেই। আমি যেন আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি সেটাই আসল। কারণ সততা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই থাকতে হবে। সেটা ব্যক্তি জীবনে যেমন থাকতে হবে, পরিবারে যেমন থাকতে হবে, তেমনি চাকরি জীবনেও থাকতে হবে।

আমি মনে করি এখনো বেশিরভাগ পরিবারই ভালো। কোন পরিবারই চায় না তার সন্তান বিপথে যাক। পরিবারগুলো ভালো আছে বলেই বাংলাদেশ এখনো ভালো আছে। তবে ভালো মানুষদের জায়গাটা আরো বাড়াতে হবে।

শিক্ষা কার্যক্রমে সততার বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি কি শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত এনজিওদের জন্য আলাদা করে কোন বার্তা দিতে চান?

শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত এনজিওদের জন্য আমার বক্তব্য হলো সরকারি লক্ষ্যের সাথে মিলিয়ে তাদেরকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। নিজেদেরকে সরকারি কাজের সহায়ক শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে হবে। একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে, এবং সেই ভাবমূর্তি রক্ষা করতে সদা কাজ করতে হবে। এনজিওদের তাদের কাজের প্রয়োজনীয়তাকে সুস্পষ্ট ও জোরাল করতে হবে। তারা যেন বিচ্ছিন্নভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে তারা কোন আদর্শ স্কুল চালাচ্ছে না, এবং তাদের কাজ হলো সরকারি স্কুলের সঙ্গে তাদের কাজকে সংযোগ করা। মূলধারার উপর জোর দিতে হবে। এনজিওদের কর্ম এলাকায় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের পরিদর্শন বাড়াতে হবে এবং এনজিও শিক্ষা কার্যক্রমের তদারকিতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের যুক্ত করার মধ্য দিয়ে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা জোরদার করতে হবে।

এনজিওদের ভাবমূর্তির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে। আমি নিজে ‘রস্কে’ কাজ করে এসেছি। সেসময়ে আমি ভুঁইফোড় এনজিও দেখেছি। ভুঁইফোড় এনজিওদের শিক্ষা কার্যক্রমে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। যারা আছে তাদেরকে চিহ্নিত করে বাদ দিতে হবে। অন্যদিকে ভালো কাজ করে এমন এনজিওদের কাজের সুযোগ দিতে হবে। তাদেরকে অগ্রাধিকার করতে হবে। উন্নয়নের ‘রিলে রেসে’ যোগ্য ও পরীক্ষিত এনজিওদের কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। অন্যদিকে যারা অযোগ্য তাদের কাজ করা বন্ধ করতে হবে কিংবা সীমিত করতে হবে।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেবার জন্য

আপনাকেও ধন্যবাদ।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031