৩৮ বছর ধরে নগরীর কাস্টঘরে বসবাস সুইপারদের। এর আগে তোপখানা এলাকায় ছিল তাদের আবাস। সব বয়েসী মানুষ মিলে ৩৬০ জন সুইপারের সংসার রয়েছে অর্ধশতাধিক। সরকারের দেয়া বহুতল ভবনেই ওই সুইপার পরিবারগুলো বসবাস করে। রাতে নগর পরিষ্কার করাই তাদের কাজ। নিতান্তই খেটে খাওয়া মানুষ এরা। কিন্তু এই নিরীহ সুইপারদের নেতা হয়ে শুধু মাদক বিক্রি করে কোটিপতি হয়েছে অনেকেই। এর মধ্যে অনেকেই নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় জমিয়েছেন সিলেট ও সিলেটের বাইরে। পুলিশের খাতায় পলাতক থাকলেও এসব সুইপার নেতারা কাস্টঘরের সুইপার কলোনিতে বসে মাদক বিক্রি করে সম্পদের মালিক হয়েছেন। পাশাপাশি প্রভাবশালীদের ‘মাদক বখরা’ দিয়ে তারা পুরো কাস্টঘরে গড়ে তুলেছেন রাজত্ব। তাদের দাপটের কাছে অসহায় সিলেটের প্রশাসনও। সিলেটের কাস্টঘরের সুইপার কলোনির সুইপারদের এসিস্ট্যান্ট সর্দার রতন লাল ও বাঘা লাল এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। মাদক বিক্রি করেই তারা এই টাকা কামাই করেছে। সিলেটের কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানিয়েছেন- সুইপার কলোনির এসিস্ট্যান্ট সর্দার রতন ও বাঘার বিরুদ্ধে মাদক মামলায় ওয়ারেন্ট রয়েছে। বিভিন্ন সময় থানায় তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু রতন ও বাঘা সব সময় থাকে ধরাছোয়ার বাইরে। গত বুধবার থেকে কাস্টঘর এলাকায় অভিযান শুরু হলে তারা দুইজনই পালিয়ে যায়। গত তিন দিন ধরে তারা সুইপার কলোনিতে নেই। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তবে, স্থানীয়রা জানিয়েছেন- দিনের বেলা রতন ও বাঘা এলাকায় না থাকলে রাত গভীর হলে তারা ফিরে আসে। এবং নিজেদের ঘরে বসেই মাদক বিক্রির হিসাব-নিকাশ নেয়। তাদের অনুপস্থিতিতেই বাঙাল চাকরেরা মাদক বিক্রি করে। ভোরের আগেই তারা আস্তানা ছেড়ে চলে যায়। সুইপার কলোনির ভেতরে থাকা মণ্ডপের পাশেই রতন লালের ঘর। ভবনের নিচতলায় থাকায় ঘরই রতনের মাদকের আস্তানা। পাশের মায়া বোর্ডিং থেকে মদ এনে পান করার বৈধতা রয়েছে তাদের। কিন্তু রাত হলেই রতনের আস্তানা মাদকসেবীদের আনাগোনায় সরব হয়ে উঠে। বাইরে থেকে প্রতিদিন বহুলোক গিয়ে তার ঘরে বসে চোলাই, বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ পান করে। পাশাপাশি গাঁজাও বিক্রি হয় তার ওখানে। বহু বছর ধরে রতন চোলাই মদ ও বিদেশি ব্র্যান্ডের বিভিন্ন প্রকারের মদ বিক্রি করলেও প্রায় ৫ বছর ধরে ইয়াবাই তাদের ভাগ্য বদলে দেয়। ইয়াবার সিলেটের অন্যতম ডিলার রতন লাল। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- রতন ও বাঘা হচ্ছে সুইপার কলোনির ইয়াবার ডিলার। রতনের বাসার সারিতেই রয়েছে বাঘার ঘর। তারা দুইজন মাদক বিক্রির ‘মানিকজোড়’। দুইজন এক সঙ্গে ইয়াবার কারবার করেন। তাদের হাতঘুরেই নগরের অর্ধেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ইয়াবার বিস্তার। তারা জানান- নগরীর দক্ষিণ সুরমার সোর্স আনোয়ারের মাধ্যমে তাদের কাছে সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন ইয়াবার চালান আসে। আর এই ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন তিনজন মহিলা। তারা নির্ধারিত দিনে একটি প্রাইভেট কার নিয়ে দক্ষিণ সুরমা থেকে কাস্টঘরে ঢুকেন। এবং সুইপার কলোনির সামনে এসে তারা গাড়ির গতি থামিয়ে একটি ব্যাগ রতন ও বাঘার হাতে দিয়ে চলে যায়। পরে ওই ব্যাগ রতন ও বাঘা নিজের ঘরে নিয়ে যায়। এভাবে মহিলাদের মাধ্যমে রতন ও বাঘার কাছে আসে ইয়াবার চালান। আর এই ইয়াবার চালান আসার খবর জানেন সুইপার কলোনির অনেকেই। কিন্তু তারা সর্দারের কোপানলে পড়ার আশংকায় মুখ খুলেন না। স্থানীয় কয়েকজন দোকানি মানবজমিনকে জানিয়েছেন- প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০ হাজার ইয়াবার চালান আসে রতন ও বাঘার কাছে। এসব চালান থেকে সিলেটে দু’টি বিদ্যাপিঠের ক্যাম্পাসে যায় ইয়াবা। ওই দুই ক্যাম্পাসে ইয়াবা বিক্রি হয়। এর বাইরে নগরীর উত্তর অংশের বিভিন্ন স্থানে ডিলারদের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হয়। কয়েক বছর আগেও রতন তেমন টাকার মালিক ছিলো না। কিন্তু এখন রতন কোটি কোটি টাকার মালিক। স্থানীয়দের ধারণা, রতন ইতিমধ্যে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছে। কয়েক মাস আগে রতন তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে নগরীর শিবগঞ্জ এলাকায় ৩ কোটি টাকার সম্পত্তি কিনেছে। সুইপারদের বাইরে সম্পত্তি কেনায় নিষেধ থাকায় বেনামে ওই সম্পত্তি ক্রয় করা হয়েছে। পাশাপাশি নগরীর কুশিঘাট এলাকায় রয়েছে আরও ৫০ লাখ টাকা মুল্যের জমি। রতন নিজে নাম পরিবর্তন করে ওই জমি ক্রয় করেছে বলে জানা গেছে। রতন গত মঙ্গলবার কাস্টঘরের সুইপার কলোনির উল্টোদিকের পতিত জায়গায় বিশাল আয়োজনে তার নাতির জন্মদিন পালন করেছে। প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয়ের এই আয়োজনে এলাকার লোকজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়, নাচ-গানের আয়োজন করে। এই নাচ-গানের আয়োজনের কারনে সম্প্রতি সময়ে সুইপার কলোনির অপরাধ সাম্রাজ্যের প্রতি পুলিশের নজর পড়েছে বলে জানান এলাকার বাসিন্দারা। রতন থেকে সম্পত্তি কম নয় বাঘা লালের। ইয়াবা ব্যবসা বাঘা লালের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। রতনের সহযোগি হয়ে সে ইয়াবার চালান পৌছে দেয় নগরীর বিভিন্ন স্থানে। সিলেটে বাঘার সম্পদের কোনো হিসার কারও জানা নেই। তবে- কোটি টাকার সুদের কারবার রয়েছে বাঘার। ব্যবসায়ী, স্থানীয় লোকজন থেকে শুরু করে অনেকেরই কাছে সুদে টাকা খাটাচ্ছেন। বর্তমানে বাঘার প্রায় কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে রক্ষিত রয়েছে। এর বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শ্বশুরবাড়িতে বহু সম্পত্তি কিনেছেন বাঘা। এই সম্পত্তির মালিক তিনি কম সময়ের ব্যবধানে হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। রতন ও বাঘার সহযোগী কাস্টঘরের সুইপার কলোনির আর প্রায় ১৫ জন বাসিন্দা চোলাই মদ ছেড়ে ইয়াবা ব্যবসায় নাম লিখিয়েছেন। এবং তারা লাখপতি থেকে কোটিপতি হওয়ার পথে রয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছে পান্নু লাল, রাজেশ লাশ, রাঙা লাল, ঝন্টুলাল, হিরণ লাল, ঝুলন লাল। আর সম্প্রত্তি সময়ে আরও কয়েকজন বিক্রেতার নাম পুলিশের হাতে পৌঁছেলে। এদের মধ্যে রয়েছে- সল্টু, পাপ্পু, বিন্দিয়া, কেৎলি উমেন্দ, অনিল, সোহাগ ও বিধান। পুলিশ তাদের খুঁজে বেড়ালেও গতকাল পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এদিকে- সিলেট নগরীর কাস্টঘরের সুইপার কলোনির রয়েছে তিনটি প্রবেশমুখ। ওই তিন প্রবেশমুখে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের কোনো উদ্যেগ গ্রহণ করা হয়নি। সিলেট সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিম সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগী হলেও পরবর্তীতে বাধার মুখে তা আর স্থাপন হয়নি। মাদক ব্যবসায়ীরাই তাদের সুবিধার জন্য ওই এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে দেয় না। সিলেট মহানগর পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জেদান আল মুছা গতকাল নিজেও স্বীকার করেছেন কাস্টঘরের সুইপার কলোনির তিনটি প্রবেশমুখে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। তিনি জানান- পুরো কাস্টঘরকে সিসিটিভি’র আওতার আনার প্রক্রিয়া রয়েছে সিলেট মহানগর পুলিশের। আর পুরো এলাকা সিসিটিভি’র আওতায় চলে এলে অপরাধীদের শনাক্ত করার সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।