প্রথম সন্তান পরিবারের । সবার আদরের দুলাল। মাথাও ভালো। লেখাপড়ায়ও যথেষ্ট মনোযোগী। স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে নামকরা ডাক্তার হবেন। মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! আজ নিজেই মাদকাসক্ত হয়ে শুয়ে আছেন চিকিৎসা কেন্দ্রে। রাজধানীর কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের বিছানায় শুয়ে জীবনের গল্প শোনান তৌহিদ আহমেদ চৌধুরী। জীবনের সোনালী অধ্যায় স্মরণ করে হারিয়ে যাওয়া অতীতে ফিরে যান। তৌহিদ বলেন, বাবা মহাখালীর ওয়্যারলেস এলাকার নামকরা দলিল লেখক ও ব্যবসায়ী। টাকার কোনো অভাব নেই। ঢাকার নামকরা স্কুলে ভর্তি করা হয়। অল্প দিনেই অনেক বন্ধু জুটে যায়। সবাই বড় লোকের সন্তান। এক সঙ্গে সবাই দিনে রাতে আড্ডা দিতাম, স্কুলে যেতাম। আস্তে আস্তে বন্ধুদের সঙ্গে কৌতূহলী হয়ে শখের বশে সিগারেটে টান দিতাম। পরিবারগত একদম স্বাধীন হওয়ায় বন্ধুমহলের পাল্লায় পড়ে মাদকের রঙিন জগতের সঙ্গে পরিচিত হই। রঙিন জগতে যাতায়াতে সিগারেট থেকে গাঁজা, গাঁজা থেকে ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদক সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। এখন আমি মাদক রাজ্যের সর্বভোগী। চারদিকে শুধু ইয়াবার গন্ধ পাই। হাতে না পাইলেই বাসায় চালিয়েছি ব্যাপক ভাঙচুর। স্কুলের বই খাতা ফেলে ১৩ বছর আগে হাতে তুলে নিয়েছিলাম মাদক অস্ত্র। সেই অস্ত্রের আঘাতে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি। আহত হচ্ছি। আহত হয়ে ভর্তি হয়েছি সরকারি এই হাসপাতালে। তৌহিদ আহমেদ চৌধুরীর চেয়ে স্বপ্ন পূরণে আরো কাছাকাছি চলে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জের আমিনুল ইসলাম। মেধা তালিকায় স্মরণীয় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে স্কুল, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে আমিনুল পৌঁছে যান উচ্চ শিক্ষার বারান্দায়। আমিনুলের বড় স্বপ্ন-বিবিএতে অনার্স শেষ করে বাবার ব্যবসাতে যোগ দিয়ে দেশের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠবেন। কিন্তু হঠাৎ অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াবস্থায় তার স্বপ্নে আঘাত হানে মাদকের ভয়ানক কালবৈশাখীর ঝড়। লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় আমিনুলের সব স্বপ্ন। আমিনুল মানবজমিনকে বলেন, দীর্ঘ আট বছর নাসরিনের সঙ্গে আমার প্রেম ছিল। দুজন দুজনকে পাগলের মতো ভালোবাসতাম। হঠাৎ করে আমাকে না জানিয়ে নাসরিন চলে যায় অন্য পুরুষের হাত ধরে । দীর্ঘদিনের প্রেম বিরহ সহ্য করতে না পেরে দ্বারস্থ হই লাল রঙের ইয়াবার কাছে। ইয়াবা, ফিনসিডিল, হেরোইন, কোকেন ও আফিম আমাকে ১০ বছর পর্যন্ত সাময়িক শান্তি দিয়ে পৌঁছে দেয় গভীর মৃত্যু কূপে। সেই মৃত্যুকূপ থেকে টেনেহিঁচড়ে শুয়ে দিয়েছে রাজধানীর এই কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। তৌহিদ ও আমিনুলের পথের আরেক ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ওয়াসিম ভূঁইয়া। নারায়ণগঞ্জের নামি ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র সন্তান। ওয়াসিমকে নিয়ে বাবার আকাশচুম্বী স্বপ্ন- দেশের গণ্ডী পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাবে। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে পিতার সেই মনের আশা জ্বালিয়ে দেয় ওয়াসিম। এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস পাওয়ায় বাবার সেই স্বপ্ন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ওয়াসিম তখন ভাঙ্গা কণ্ঠে প্রতিবেদককে বলেন, ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে কলেজে ভর্তি হই। আবেগী মন যা চায় তাই করি। বাসায় বন্ধুরা আসা যাওয়া করতো। কলেজ বন্ধুদের মাধ্যমে লাল রঙের ইয়াবা ট্যাবলেটের সঙ্গে পরিচিত হই। কৌতূহলী হয়ে বন্ধুদের দিনের পর দিন আবদার রাখতে গিয়ে মাদক সেবন শুরু করি। মাদক জগতের হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজা ও ফেনসিডিলের সঙ্গে বসবাস করেছি টানা ১২ বছর। মাদকের ছোবলে বিষাক্ত শরীর নিয়ে ওয়াসিম এখন ভর্তি আছেন তেজগাঁও মাদক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে। ওয়াসিম মানবজমিনকে বলেন, মাদক আমার সুখের জীবন, বেঁচে থাকার আশা এমনকি পরিবারের আকাশছোঁয়া স্বপ্ন নিঃশেষ করে দিয়েছে। তারপরও ২৬ দিনের চিকিৎসায় ওয়াসিম অনেকটাই মানসিকভাবে সুস্থ। চিকিৎসা শেষে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন এমনটাই আশা ওয়াসিমের।
পরিবারে সবার ছোট রিপন। মায়ের কলিজার টুকরা। রিপনকে ছাড়া একরাতও ঘুমুতে পারেন না মা। স্কুলে যেতেও রিপনের পাশে ছায়ার মতো লেগে থাকেন মা আয়েশা। একটু চোখের আড়াল হলেই মায়ের মন হু হু করে কেঁদে ওঠে। কেবল ক্লাস নাইনে উঠেছে সে। তখন থেকেই মায়ের চোখে রিপন বদলে যায়। বৃহস্পতিবার তেজগাঁও মাদক নিরাময় কেন্দ্রে বসে বদলে যাওয়ার কাহিনী বলেন পুরান ঢাকার কিশোর রিপন। চোখে প্রচণ্ড ঘুম নিয়ে রিপন বলেন, ক্লাস নাইনে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে। ক্লাসের বাইরে নিয়মিত বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতাম। সিনেমা দেখতাম। ছুটির দিনে বন্ধুদের বাসায় গিয়ে মজা করে সিগারেটে টান দিতাম। দিনের পালাক্রমে শুরু করি ইয়াবা সেবন। ভুলে যাই সবকিছু। পৃথিবীতে আমার সবাই পর। কাউকে আমার আপন মনে হয় না। শুধুই আমার আপন ইয়াবা। তেজগাঁও নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করতে নিয়ে এসে ছেলের কথাগুলো শুনে রিপনের মা হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার রিপন আর রিপন নাই। সব সর্বনাশ করে দিয়েছে ওর বন্ধুরা।
পরিবারে সবার বড় শাহিনুর। সবাই ডাকে শাহিন পেইন্টার। ছবি দেখলেই সখের বশে জটপট ছবি আঁকা। নেশা থেকে শাহিনুরের পেশা হয়ে যায় পেইন্টিং। একদিন কল্পনার তুলি দিয়ে একটি মেয়ের চমৎকার ছবি এঁকে দেয়ায় পেইন্টারের প্রেমে পড়ে যায় মেয়েটি। অবশেষে ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে বেজায় সুখী শাহিনুর। বছর শেষে কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। এতে ছড়িয়ে পড়ে পরিবারে অসীম সুখ আর বাইরে পেইন্টিং সুনাম। ঘটনা বলতে গিয়ে শাহিনুরের কণ্ঠ বসে যায়। চাপা কণ্ঠে শাহিনুর বলেন, পেইন্টিং সুনামের সুবাদে তৈরি হয়ে যায় অনেক বন্ধু। হঠাৎ একদিন এক বন্ধুর আবেদনে বিয়ে পার্টিতে যাই দাওয়াত খেতে। সেখানে রাতভর বন্ধুরা মিলে সখের বশে মদ পান করি। একদিন দুদিন করে মদ খাওয়া নেশায় পরিণত হয়ে যায়। একদিন মদের নেশার কাছে শাহিনুরের পেইন্টিং নেশা পরাস্ত হয়। ফলে স্ত্রী সন্তানের সুখের সংসার ছেড়ে ধীরে ধীরে ইয়াবার জগতে প্রবেশ করেন শাহিনুর। মাদকের রঙ্গিন জগতের এই বাসিন্দা দীর্ঘ ৯ বছর পর্যন্ত কল্পনায় এঁকে চলেছেন বৈচিত্রধর্মী দেশি বিদেশি মাদকের ছবি। এখন শাহিনুর সব ধরনের পেইন্টিং ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ভর্তি হয়েছেন তেজগাঁও কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। তবে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে পূর্বের পেইন্টিং সুনাম ফিরে পাবেন কিনা জানেন না নারায়ণগঞ্জের এই পেইন্টার শাহিনুর।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031