পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। একদিকে মানবিকতা, অন্যদিকে বাস্তবতা। মুখ্য দু’টি বিষয়কে সামনে রেখেই চলছে রোহিঙ্গা সংকট সামলে ওঠার চেষ্টা।  ত্রাণকর্মীদেরও ত্রাহি অবস্থা। নতুন-পুরাতন মিলে প্রায় ১০ লাখ উদ্বাস্তু মিয়ানমার নাগরিকের খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসাসহ জীবন রক্ষার ন্যূনতম নিশ্চয়তা নিশ্চিতেই দেশি-বিদেশি যতসব উদ্যোগ। কিন্তু বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে প্রশাসনের উদ্বেগেরও শেষ নেই। রোহিঙ্গাদের নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। মাদক, মানবপাচার, চোরাচালান, পরিবেশের বিনাস, নারী ব্যবসাসহ মোটাদাগে ৫টি অপরাধে পুরনো অনেক রোহিঙ্গার সম্পৃক্ততার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে। এছাড়া তথ্য পাচারে কতিপয় রোহিঙ্গার জড়িয়ে পড়ার নতুন শঙ্কা তাড়া করছে প্রশাসনকে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির গহিন সীমান্ত থেকে সন্দেহভাজন ৪ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছিল। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হলেও তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ভুয়া ঠিকানা ও আইডি ব্যবহার করে লাখেরও বেশি মোবাইল সিম কার্ড তুলে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। এ নিয়ে সরকারের তরফে অবশ্য চটজলদি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তের সব মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রশাসন বলছে, নবাগত রোহিঙ্গারা যেন পুরনোদের পথে হাঁটতে না পারে তা নিয়ে আগেভাগেই সতর্ক সরকার। নীতিনির্ধারক ও সরকারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া, টেকনাফসহ গোটা কক্সবাজার এলাকাকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। এ লক্ষ্যে বাড়ানো হয়েছে ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারি। ত্রাণ বিতরণ, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়সহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তায় সশস্ত্র বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, তারা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাদের কি রাখাইনে ফেরানো যাবে, নাকি জনবহুল বাংলাদেশকেই এ ঘানি টানতে হবে? বর্মী বাহিনীর বর্বর নির্যাতনে প্রাণ বাঁচাতে জন্মভিটা ছেড়ে আসতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গারা কি ত্রাণের ওপর নির্ভর থাকবে, নাকি তারা এদেশে কর্মক্ষেত্র এবং মূল স্রোতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করবে? সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা বিষয়ে স্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, এখন থেকে আর কোনো রোহিঙ্গা রাস্তায় থাকতে পারবেন না। সরকারের বরাদ্দ দেয়া এলাকাতেই তাদের থাকতে হবে। কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পেছনে সরকার এরইমধ্যে ২০০০ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে নবাগতদের জন্য। ওই এলাকায় তাদের জায়গা না হলে আরো জমি বরাদ্দ করা হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই রোহিঙ্গারা ক্যাম্প এলাকার বাইরে যেতে পারবেন না। যদিও এরই মধ্যে নবাগত প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ আছে। তারা পুরনো রোহিঙ্গা স্বজনদের সহায়তায় শহর, উপজেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়িভাড়া নিয়েছেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে জেলার ২৫টির বেশি পয়েন্টে তল্লাশি চলছে বলে জানিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, অতিরিক্ত পাঁচজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, চার প্লাটুন বিজিবি, ৬০ জন অফিসারসহ ৩৬০ জন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় আনসার সদস্য, স্কাউট সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবী সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ এবং আশ্রয় কাজে শৃঙ্খলা ফেরাতে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তায় এরইমধ্যে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে থাকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় কেন্দ্র ও পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিতেও সেনাবাহিনী কাজ করবে বলে জানানো হয়েছে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পুলিশের পেট্রল টিম সারাক্ষণ কাজ করছে। গোটা এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কেবল পুলিশ নয়, দেশের অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সেখানে সক্রিয় রয়েছে। সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা এখনো কোনো অশুভ তৎপরতার খবর পাইনি। তবে সতর্ক রয়েছি। রোহিঙ্গারা যাতে টেকনাফ এবং উখিয়ার নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে না পারে সে জন্য পথে পথে তল্লাশি টিম রয়েছে বলেও জানান পুলিশ সুপার। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সরকারের বরাদ্দ করা জমিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর পুরো এলাকা কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হবে। এতে সেখানে ত্রাণ কার্যক্রমে যেমন শৃঙ্খলা আসবে তেমনি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগও কমবে। সীমান্ত এলাকায় থাকা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি সতর্ক রয়েছে জানিয়ে কক্সবাজারের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মন্‌জুরুল হাসান খান মানবজমিন বলেন, আমরা সব সময় সতর্ক রয়েছি। কয়েকজন রোহিঙ্গা সীমান্ত এলাকায় গুপ্তচরবৃত্তি করছে মর্মে যে অভিযোগ ওঠেছে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, সন্দেহভাজন ৪ জনকে ধরা হয়েছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সীমান্ত বাহিনী বিজিপির সোর্স হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে মর্মে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে তার কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কি-না জানতে চাইলে লে. কর্নেল মন্‌জুর বলেন, ‘ভালো কথা বলেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখছি।’ এদিকে ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সোহেল ফেরদৌস বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপে রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রশাসনের শঙ্কার কথা জানান। বলেন, ‘তারা যেহেতু বাস্তুচ্যুত মানুষ এবং আর্থিক সমস্যাও রয়েছে, কোনো অপরাধী চক্র তাদেরকে যেকোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে পারে। অথবা তারা স্বেচ্ছায় কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত হতে পারে। এটার জন্য আমরা সতর্ক আছি। তিনি বলেন, ‘আমাদের ইন্টেলিজেন্সের মনিটরিং আছে। আমাদের নিজস্ব যেসব ব্যবস্থা আছে, তার মাধ্যমে আমরা তাদের পর্যবেক্ষণে রেখেছি। সামাজিক মাধ্যমগুলোও কোনো প্রপাগান্ডা বা কর্মকাণ্ড চালাতে না পারে, সে বিষয়টিও নজরদারি করা হচ্ছে।’

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031