স্বামীর লাশ ফেলে অনাগত সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে এপারে চলে আসেন হুমায়রা। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তার গর্ভের সন্তানটি নষ্ট হয়ে যায়। এপারে এসেও কোনো আশ্রয়স্থল জোগাড় করতে পারেননি। টাকার অভাবে চিকিৎসাও নিতে পারেননি। সাত দিন ধরে অনাহারে-অর্ধাহারে বালুখালি মাদরাসার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন। ‘এখান থেকে তাড়ালে যাব কোথায়’ বলে বোরকার আড়ালে কান্নায় ভেঙে পড়েন হুমায়রা।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর দৌরাবিল গ্রামের বাসিন্দা হুমায়রা (১৮)। তার বিয়ে হয়েছে আট মাস আগে। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হুমায়রাকে বর্মি সেনারা ধর্ষণের চেষ্টা করলে বাধা দিতে যান স্বামী রহমত উল্লাহ (২২)। তার চোখের সামনে স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে জান্তারা।

বুধবার সকালে সীমান্তের ঘুনধুম, তুমব্রু, বালুখালী, কুতুপালংয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে হুমায়রার মতো অসংখ্য ধর্ষিতার আহাজারি ধ্বনিত হয়।

হুমায়রার সঙ্গে এসেছে তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী সেনোয়ারা (২৫)। তার স্বামী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। চার সন্তান নিয়ে তারা সুখেই ছিলেন। সেনোয়ারা বলেন, হায়েনার দল তাদের বাড়িতে এসে স্বামী আলী আহম্মদকে (২৮) ধরে নিয়ে যায়। পরে শোনেন আহম্মদসহ ১৮ জন গ্রামীকে মেরে ফেলেছে সেনারা। উপায়ন্তর না দেখে ননদ হুমায়রাকে নিয়ে এপারে চলে আসেন।

সেনোয়ারা বলেন, ‘সাত দিন ধরে পথ পাড়ি দিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে। ক্ষুধার্র্ত শিশুটি কেঁদে ওঠে। কিছু কিছু লোকজন খাবার দিলেও ছোট শিশুটিকে তা খাওয়াতে পারছি না।’

পলেথিনের নিচে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা এখন আবার বৃষ্টির ভোগান্তিতে পড়েছে। অধিকাংশ পলিথিনের আশ্রয় ডুবে গেছে পানিতে। টানা বর্ষণ ও বজ্রপাতে ছোট ছোট শিশুরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লে তাদের বুকে নিয়ে রাস্তার ধারে ঠাঁই নেয় নারীরা।

পলিথিনের ঝুপড়িতে ত্রাণের জন্য অপেক্ষমাণ বিধবা মরিয়াম (২২)।  স্বামী, শ্বশুর ও দেবরকে হারিয়েছেন তিনি। মরিয়ম বলেন, ‘এক রশিতে বেঁধে তিনজনকে হত্যা করে মিয়ানমার সেনারা। বাড়িটি জ্বালিয়ে দিয়েছে। সর্বস্বান্ত হয়ে এখানে এসেছি। পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে তিন দিন ধরে এখানে-ওখানে ঘুরছি। কোথায় কোনো আশ্রয় মেলেনি, খাবার মেলেনি।’

মংডুর খাইজাবিল থেকে পালিয়ে আসা বিধবা গুলজার বেগম (২০) জানান, তার বিয়ে হয়ে তিন মাস আগে। তিনি এখন অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী ইউনুচকে (২২) মিয়ানমার সেনারা জবাই করে হত্যার কথা বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন গুলজার। তার মা-বাবারা কোথায় আছে কেমন আছে জানেন না। শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে বালুখালী খালের পাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মঙ্গলবার রাতের বৃষ্টির পানিতে পলেথিনের ঝুপড়ি ভেসে গেছে। রাতভর রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছেন।

সর্বস্বান্ত হয়ে আসা বেশ কয়েকটি দম্পতির সাথে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা পরিবারের মধ্যে অধিকাংশ নবদম্পতি তাদের স্বামীকে হারিয়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে এ দেশে আসা  ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। এখানে না খেয়ে মরলেও গুলি, ধর্ষণ ও জবাই করার মতো কিছু ঘটবে না বলে শরণার্থী হয়েছেন তারা।

বুচিদং নামারপাড়া গ্রামের নুরু সালাম (৩৫) বলেন, তার মেয়ে ইয়াজমিন আকতারকে (১৬) ধর্ষণ করে মিয়ানমার সেনারা। বাবা নুর আহম্মদকে (৫৫) ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিপণ হিসেবে মিয়ানমার সেনারা ৫০ লাখ কিয়াত নিলেও তাকে বাঁচায়নি। সবার সামনে গুলি করে হত্যা করেছে। বাবার মৃত্যু দেখে পরিবার-পরিজনের প্রাণ বাঁচাতে এখানে পালিয়ে এসেছেন। তার অগাধ সহায়-সম্পত্তি থাকার পরও নিঃস্ব হয়ে আসতে হয়েছে বলে আক্ষেপ করেন।

কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা নেতা ডা. জাফর আলম (প্রকাশ ডিপু জাফর) জানান, রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা পরিবারের মধ্যে অধিকাংশ যুবতী ও সদ্য বিবাহিতা নারীদের নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হয়েছে। মেরে ফেলা হয়েছে তাদের স্বামীকে। বর্বরোচিত নির্যাতনে রক্তক্ষরণের ফলে বিমর্ষ ৫ শতাধিক রোহিঙ্গা নারীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031