রোহিঙ্গা নারী রহিমা বেগম প্রাণ বাঁচাতে পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে গত মঙ্গলবার গভীর রাতে নৌকায় ওঠেন। তাঁদের বহন করা ছোট নৌকাটিতে আরোহী ছিল মোট ৩৫ জন। সবার বাড়ি মিয়ানমারের মংডু শহরের হাসুরাতা গ্রামে। নাফ নদী পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করার পরই প্রবল ঢেউয়ের কবলে পড়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি। এরপর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই। নৌকা ডুবে যাওয়ার পর রহিমা বেগম তাঁর এক ছেলেকে নিয়ে সাঁতরে কূলের দেখা পেলেও অন্যরা গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন।
গতকাল সকাল নয়টা পর্যন্ত কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকার সৈকতে ডুবে যাওয়া ওই নৌকার পাঁচ আরোহীর লাশ পাওয়া যায়। তবে তাদের মধ্যে রহিমার পরিবারের কেউ ছিল না। নিখোঁজ রয়েছেন রহিমার স্বামী রবি আলম, বড় মেয়ে হামিদা বেগম, মেজ মেয়ে রুবিনা বেগম, ছোট ছেলে রশিদ উল্লাহ এবং রহিমার মা নুরজাহান। প্রাণে বেঁচে গেছেন রহিমা ও তাঁর মেজ ছেলে বশির উল্লাহ।
ওই পাঁচজনসহ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের নাফ নদী ও সাগর থেকে মোট ১৭ জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ লাশ ছিল পাঁচজনের। এ ছাড়া মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত রোহিঙ্গাবাহী ১১টি নৌকা ডুবেছে নাফ নদী ও সাগরে।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, উখিয়া উপজেলার পালংখালী সীমান্তে নাফ নদীতে গতকাল বিকেলে ভেসে আসে গুলিবিদ্ধ পাঁচ রোহিঙ্গার লাশ।
এর আগে গত ২৯ আগস্ট রাত থেকে ৩১ আগস্ট সকাল পর্যন্ত টেকনাফের নাফ নদী ও সাগরে ছয়টি নৌকাডুবির ঘটনায় ৫৭ জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে গত আট দিনে ৭৪ জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হলো।
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফজলুল হক বলেন, সাঁতরে তীরে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা জেনেছেন যে নৌকাডুবির ঘটনায় অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা নিখোঁজ রয়েছে।
গতকাল সকাল সাতটার দিকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ঘোলারচরে কথা হয় স্বজনদের খুঁজতে থাকা রোহিঙ্গা নারী রহিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ রকম হবে আগে জানলে সবাইকে নিয়ে গ্রামে থেকে যেতেন। এখন কীভাবে থাকবেন তিনি?
রহিমার মতোই আরেক রোহিঙ্গা নারী মোহছেনা বেগম ঘোলারচর সাগর উপকূলে তিন বছরের মেয়ে সাহারা খাতুনকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁর স্বামীকে গত বছর ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এরপর আর ফেরেননি তিনি। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে দিন কাটছিল তাঁর। গত মঙ্গলবার রাতে গ্রামের লোকজনের সঙ্গে তিনিও নৌকায় ওঠেন। নৌকাডুবির পর থেকে মেয়ে সাহারা খাতুন নিখোঁজ।
৮০০ নৌকায় রোহিঙ্গা পারাপার!
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে প্রতিদিনই শত শত রোহিঙ্গা টেকনাফে আসছে। প্রায় ৮০০ মাছ ধরার নৌকা রোহিঙ্গা পারাপারে জড়িত বলে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, শাহপরীর দ্বীপ, খুরেরমুখ, সাবরাং, মহেশখালীয়াপাড়া, নাইটংপাড়া, বাহারছড়া, বড়ডেইল, শাপলাপুর উপকূল দিয়ে প্রায় ৮০০ নৌকা চড়ে রোহিঙ্গারা টেকনাফে ঢুকছে। কিছু জেলে এ কাজে জড়িত।
গতকাল সকালে শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া ও ঘোলারচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় পাঁচটি নৌকায় করে অন্তত দেড় শ রোহিঙ্গা এসেছে। নৌকাগুলো সাগরতীরে না ভিড়ে বুকপানিতে রোহিঙ্গাদের নামিয়ে দিচ্ছে। সেখানে কথা হয় রাখাইন রাজ্যের রাছিদং গ্রাম থেকে আসা বৃদ্ধা জুলেখা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, সবদিকে জীবনের ঝুঁকি। তারপরও প্রাণ বাঁচাতে পরিবারের নয়জন সদস্য পালিয়ে এসেছেন।
এদিকে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) উদ্যোগে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে গতকাল সকালে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন। সভায় বক্তব্য দেন টেকনাফ থানার ওসি (অপারেশন) শফিউল আজম, উপজেলা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম, নয়াপাড়া সীমান্ত তল্লাশিচৌকির সুবেদার আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। সভায় নৌকার মালিক ও মাঝিমাল্লারা উপস্থিত ছিলেন।
ওসি শফিউল আজম বলেন, নৌকা দিয়ে রোহিঙ্গা পারাপার করতে গিয়ে একাধিক নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে। ভবিষ্যতে তা আর হতে দেওয়া যায় না। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নৌকার মালিক ও মাঝিমাল্লাদের সহায়তা চান তিনি।
এদিকে মিয়ানমারের আরও পাঁচ রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন নারীও রয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে তাঁদের ভর্তি করা হয়। তাঁরা হলেন হাসিনা (১৮), শফিক আলম (২৫), জাফর আলম (২৫), ওসামা (১৬) ও ইয়াহিয়া (১৮)। হাসিনার দুই পায়ে গুলি লাগে বলে জানান হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপসহকারী পরিদর্শক আলাউদ্দিন তালুকদার। ২৬ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত মোট ৫৩ জন রোহিঙ্গা এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন।