দালালদের রমরমা বানিজ্য চলছে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে । টেকনাফের সমুদ্র উপকুলীয় অধিকাংশ জেলে নৌকার মালিক ও মাঝি এখন রোহিঙ্গা পাচারের দালাল হিসেবে কাজ করছে। তাদের সংখ্যা কয়েক হাজার। টেকনাফের শামলাপুর থেকে শাহপরীরদ্বীপ পর্যন্ত ২০/২৫ টি নৌঘাটে ২ হাজারের বেশী ফিশিং বোট রয়েছে। এসব ফিশিং বোট এখন মৎস্য শিকারের পরিবর্তে মিয়ানমার উপকুল থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই করে আনতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
২০ থেকে ৩০ জন ধারণ ক্ষমতার ছোট ছোট এই ফিশিং ট্রলারগুলো রাতের অন্ধকারে মিয়ানমার উপকুলে ভিড়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এপারে চলে আসে। আবার এই সমস্ত দালালদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এক সময় মালয়েশিয়া মানব পাচারে জড়িত গডফাদারদের। আর এই গডফাদারদের রয়েছে মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের দালালদের যোগসুত্র। প্রবাসে থাকা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের লোকজন গডফাদারদের মাধ্যমে তাদের পরিবারের লোকদের মোটা অংকের বিনিময়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসছেন। আর এতে মুখ্যভুমিকা পালন করছে সমুদ্র উপকুলের মাঝি ও জেলেরা। যারা এখন দালালে পরিনত হয়েছে। প্রসংগত, আইনশৃংখলা বাহিনী ইতিমধ্যে ৪২ জন দালালকে আটক করে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে সাজা প্রদান করেছে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দালালরা জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় করছে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে টেকনাফ উপকুল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। যারা টাকা দিতে পারছেনা অথবা টাকার পরিমাণ কম তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে স্বর্ণলংকার, টাকা, কাপড় চোপড়সহ যাবতীয় মুল্যবান যা কিছু। আবার পরিবারের দুই একজন সদস্যদের বন্ধি রেখে বাকীদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে দালালদের চাহিদা মতো টাকা সংগ্রহ করে আনতে। শুধু তাই নই, দালালদের চাহিদা মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার ডুবিয়ে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে যাচ্ছে এই দালালরা।
জানা গেছে, সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই দালাল সিন্ডিকেট তাদের এই বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।
রাখাইন রাজ্যের উদং থেকে আসা মোক্তার আহমদের ছেলে এজাহার হোসেন মঙ্গলবার এ প্রতিবেদককে জানান, মিয়ানমার সীমান্তের নাইক্ষ্যংদিয়া হতে এপারের শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিম পাড়া পর্যন্ত জনপ্রতি ৮ হাজার টাকায় দরদাম করে আসলেও অতিরিক্ত টাকা দাবী করে। টাকা পরিশোধ করতে না পারায় শাহপরীরদ্বীপ উত্তর পাড়ার কালা নামের এক দালাল তার পরিবারের মা ও ভাইসহ ২ জনকে আটকে রাখে। তারা ওই নৌকায় ২৫ জন পাড়ি দিয়েছিল বলেও জানান তিনি। বর্তমানে তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে জানা যায়নি।
একিই ভাবে রাখাইনের মেরুল্লা এলাকা থেকে আসা মোঃ জাকারিয়া জানান, তার ভাষায় বোটওয়ালা দালাল তার স্ত্রীর কাছ থেকে দেড় ভরি ওজনের স্বর্নের চেইন ও কাপড় চোপড় কেড়ে নিয়েছে ও পরিবারের ৩ সদস্যকে আটকে রেখেছে। সদর ইউনিয়নের নতুন পল্লান পাড়া এলাকার মাঝিরূপী ওই দালালের নাম না জানলেও তার একটি মোবাইল নাম্বার (০১৮৭৭৫৫০৩৮৬) সংগ্রহে রয়েছে।
এই নাম্বারের যোগাযোগ করা হলেও ওই দালাল দাবী করেন, পুলিশ-বিজিবির সামনে ট্রলার করে মঙ্গলবার ভোরে লম্বরী ঘাটে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসে। পুলিশ-বিজিবির দায়িত্বরত ওই সদস্যরা বলে ট্রলার ভাড়া নিয়ে রোহিঙ্গাদের যেতে দাও।
এভাবেই সীমান্ত জুড়ে দালাল চক্রের রমরমা বানিজ্য চলছে। স্থানীয়সুত্রে জড়িত দালাল চক্রের সদস্য যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলো সদর ইউনিয়নের রাজারছড়া ঘাটের ছৈয়দ হোসেন, মৌলভী মোক্তার আহমদ, মোঃ ইসমাইল, মোঃ হাছন, কবির মেম্বার, কালামিয়া, নজির আহমদ, মোঃ আলী, তজিল ফকির, জাবু মাঝি, আবদুল আমিন মাঝি, হাতিয়ারঘোনার ছৈয়দ মাঝি, নুর আহমদ মাঝি, নোয়াখালী এলাকার ইলিয়াছ মেম্বারের ট্রলার ও তার মাঝি ইউনুছ, একি এলাকার আয়াছ ও মাঝি বাইট্টা হোছন, জাগির মাঝি, লম্বরী এলাকার একসময়ের মালয়েশিয়া মানবপাচারকারী জাফর, ফিরোজ, জাঁহালিয়ার পাড়ার বেলাল, কালু, মিঠাপানিরছড়ার মোঃ পুতু, করাচী পাড়ার মোঃ হোছন, আনু মিয়া, সোনা মিয়া, মৌলভী ইউনুছ, মালয়েশিয়া মানব পাচারকারী মিয়ানমার নাগরিক টেকনাফ শীলবুনিয়া পাড়ার বাসিন্দা কুখ্যাত হেফ্জ মাঝি, তার ভাই মহিবুল্লাহ মাঝি, একই এলাকার জব্বরের পুত্র আবুল কালাম মাঝি, মো: মাঝি, শাহপরীরদ্বীপ ডেইল পাড়ার দুদু মিয়ার পুত্র শুক্কুর, পশ্চিম পাড়ার মো: শফির পুত্র নজির আহমদ, কবির আহমদ, মাঝের পাড়ার সিরাজের পুত্র কলিমুল্লাহ, ঘোলার পাড়ার জমির উদ্দিনের পুত্র কবিরা, পূর্ব উত্তর পাড়ার মৃত নজির আহমদের পুত্র জিয়াবুল, জালিয়া পাড়ার শামীম, পশ্চিম পাড়ার কালা ফকিরের পুত্র মো: জালাল, মিস্ত্রি পাড়ার হাসিমের ছেলে লম্বা সেলিম, মৃত বশির আহমদের ছেলে এনায়েত উল্লাহ, দক্ষিণ পাড়ার মোহাম্মদ উল্লাহ মাঝির ছেলে কাউছার, আনুর ছেলে ইলিয়াছ, ছলিমের জামাতা রশিদ আমিন, নুর হোসেন, শামসু, রহমত উল্লাহ, সাবরাং মুন্ডার ডেইল এলাকার মৃত ইউছুপ আলীর পুত্র ফজল মাঝি, কালু ফকিরের পুত্র আব্দুল আমিন প্রকাশ লালু মাঝি, টেকনাফ মহেষখালীয়া পাড়ার রফিক মাঝি, সৈয়দুল আমিন মাঝি, হ্নীলা জাদিমুড়া এলাকায় রয়েছে আব্দু মোনাফের ছেলে আমীর হামজা, জাদিমুড়া নয়াপাড়া এলাকার লম্বা আব্দুল আমিন প্রমুখ।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: মাইন উদ্দিন খাঁন জানান, রোহিঙ্গাদের সহায়তার নামে যারা অপরাধ করছে সে সব দালালদের ধরতে পুলিশ কাজ করছে। ভ্রাম্যমান আদালতে ৪২ দালালকে সাজা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ওসি আরো জানান, রোহিঙ্গাদের নিয়ে যারা ব্যবসা করবে তাদেরকে কিছুতেই ছাড় দেওয়া হবেনা।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক জানান, দালালের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অভিযান অব্যাহত আছে। ইতিমধ্যে বোট মালিক এবং জেলেদের নিয়ে সচেতনতামুলক সভাও করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে।