জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদকে (ইউএনএইচআরসি) বাংলাদেশে গুমের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছে এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টার (এএলআরসি) । ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে গুমের সংখ্যা বাড়ছে। ভুক্তভোগীদের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা এসব গুমের ঘটনার জন্য ধারাবাহিকভাবে পুলিশ ও র্যাব সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিযুক্ত করে আসছেন।
জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স (ডব্লিউজিইআইডি) ও মানবাধিকার কমিটি এসব গুমের ঘটনা বন্ধ করতে আহবান জানালেও বাংলাদেশ তা অগ্রাহ্য করা অব্যাহত রেখেছে। বরং, সরকার স্রেফ অস্বীকার করা ও দায়ীদের বিচারহীনতার নিশ্চয়তা দিয়ে এই ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে’র পক্ষালম্বন করছে। দেশটির আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত ৮ বছর ধরে এই অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিকার দিতে অনিচ্ছুক ও সামর্থ্যহীন।
গুমের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৮৮ জন মানুষ গুমের শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৯১ জনকে গুম করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালের প্রথম সাত মাসে, কমপক্ষে ৬০ জন মানুষ গুম হয়েছেন। এসব পরিসংখ্যান বাস্তবতার আংশিক চিত্র দেয় মাত্র। অনেক পরিবারই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি, ভয়ভীতি ও হুমকির কারণে উচ্চবাচ্য করার সাহস পায় না। গুমের শিকার অন্তত ১১৩ জন ভুক্তভোগী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের পরিবারের বয়ান মতে, এএলআরসি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থাগুলো নথিবদ্ধ করেছে যে, র্যাব, পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখাই (ডিবি) অপহরণ ও গুমের সঙ্গে বেশি জড়িত। নিজেদের সরকারী কর্মকর্তা দাবি করে সাদা পোশাকধারী লোকজনও অপহরণ ও গুমের সঙ্গে জড়িত বলে দেখা গেছে।
ভুক্তভোগীদের পরিবার টিকে থাকতে সংগ্রাম করছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার তরফ থেকে ভয়ভীতি ও হুমকির সম্মুখীন তারা। অভিযোগ দায়েরের কাঠামোতে তাদের প্রবেশাধিকার নেই, কারণ এটি পুলিশের এখতিয়ারাধীন। পুলিশ, র্যাব ও ডিবি পুলিশ ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেকটি গুমের ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ভুক্তভোগীদের পরিবার, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের কাছে সরাসরি ঘটনা অস্বীকার করা হয়।
স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সরাসরি সমর্থন পায় গুম সংক্রান্ত কার্যকলাপ। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুম সংঘটনের অভিযোগ এসব উচ্চপদস্থ পদাধিকারীরা ধারবাহিকভাবে অস্বীকার করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা শুধুমাত্র অস্বীকার করেই খ্রান্ত হন না। বিরোধী দলীয় নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের কথিত গুমের ঘটনা নিয়ে মজা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চিত করে দেন যে, যতদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন এসব গুমের অভিযোগ তদন্তের কোনো ইচ্ছা তার সরকারের নেই। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ক্ষমতাসীন সরকার নিজ নাগরিকদের গুম করার একটি নীতি নিয়েছে। বিচারহীনতা সহ এই নীতি পদ্ধতিগতভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
সাতক্ষিরা জেলা শহরের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার শেখ মোখলেসুর রহমান ওরফে জনির ঘটনাটি বাংলাদেশে ভুক্তভোগী পরিবারদের সংগ্রামের প্রতিফলন ঘটায়। উপ-পরিদর্শক হিমে হোসেনের নেতৃত্বে সাতক্ষিরা সদর পুলিশ গত বছর ৪ঠা আগস্ট সাতক্ষিরার নিউ মার্কেট থেকে মোখলেসুরকে তুলে নিয়ে যায়। ওইদিন মধ্যরাতের পরে কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া মোখলেসুরের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। তার স্ত্রী জেসমিন নাহার ও পিতা শেখ আবদুর রশিদ পরেরদিন মোখলেসুরকে সাতক্ষিরা সদর পুলিশের হাজতে দেখতে পান। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও, পুলিশ তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির না করে বাছবিচারহীনভাবে আটক রাখে। ৫-৭ই আগস্ট পুলিশকে ঘুষ দিয়ে মোখলেসুরকে খাবারও দেয় তার পরিবার। কিন্তু, ৮ই আগস্ট থেকে মোখলেসুর নিখোঁজ। পুলিশ তাকে কোনো আদালতের সামনে হাজির করেনি, কোনো কারাগারেও পাঠায়নি। পুলিশের কাছে জানতে চাইলেও তারা মোখলেসুরের অবস্থান জানাতে অস্বীকার করে। পুলিশ বরং তার পরিবারকে ঘটনা সম্পর্কে গণমাধ্যমকে জানাতে নিষেধ করে। মাসের পর মাস চেষ্টা করলেও গ্রেপ্তার, আটক ও পরবর্তীতে নিখোঁজের ঘটনায় সাধারণ ডায়রিও নিতে রাজি হয়নি থানা। সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, ২০১৭ সালের মার্চে জেসমিন নাহার একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিষয়টি সকলকে অবহিত করেন। পরে তিনি সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০১৭ সালের মে মাসে, একটি ডিভিশন বেঞ্চ রিট আবেদনের শুনানি শেষে এই ঘটনার বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের নির্দেশে সাতক্ষিরা জেলার প্রধান বিচারিক হাকিম হাবিবুল্লাহ মাহমুদ তদন্ত শুরু করেন। কিন্তু তদন্তের সময় পুলিশ কর্মকর্তারা মিথ্যা বলেন, যদিও প্রত্যক্ষদর্শী ও মোখলেসুরের সঙ্গে একই হাজতে থাকা বন্দীরা নিশ্চিত করেন যে, তিনি বেশ কয়েকদিন পুলিশ হাজতে ছিলেন। ওই তদন্তের রিপোর্ট হাই কোর্টের বেঞ্চে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কড়া কোনো ব্যবস্থা নেয়নি হাইকোর্ট। মোখলেসুরের গুমের ঘটনায় বিচারিক তদন্ত হলো বাংলাদেশে গত ৮ বছরে হওয়া প্রথম কোনো গুম তদন্তের ঘটনা।
এএলআরসি ও এর আংশীদাররা বেশ কয়েকটি মামলা নথিবদ্ধ করেছে যেখানে দেখা যায়, পরিবার আইনি প্রতিকার চেয়ে বিচার বিভাগের শরণাপন্ন হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, হাইকোর্টে রিট আবেদনকারীরাও কোনো প্রতিকার পাননি।
উচ্চ আদালতে চরম মাত্রার রাজনৈতিক নিয়োগ হলো গুম, বিচার বহির্ভ’ত হত্যাকা- ও অন্যান্য মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনায় প্রতিকার না পাওয়ার অন্যতম কারণ।
জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস (ডব্লিউজিইআইডি) ও মানবাধিকার পরিষদকে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংক্রান্ত সমস্যাগুলো বুঝতে হবে যেগুলো সরাসরি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কৌশলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজের অপ্রাপ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা স্থায়ী করা ও এ ধরণের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা এগিয়ে নিতে ধ্বসে পড়া বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করা হলো এসব গুম ও অন্যান্য মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রধান কারণ। ডব্লিউজিইআইডি সহ স্পেশাল প্রসিডিউরস-এর উচিত বাংলাদেশ সফরের অনুরোধের কথা দেশটিকে আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মেনে নেওয়া প্রয়োজন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারই কেবল পারে গুম ও অন্যান্য মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘণ থামানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে। এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিৎ আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |