অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত মঙ্গলবার এক রায়ে মুসলমানদের তিন তালাক প্রথাকে । যেভাবে পর পর তিনবার তালাক উচ্চারণ করে অথবা চিঠি লিখে, সামাজিক মাধ্যম বা ফোনে তিনবার তালাক উচ্চারণ করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেওয়া হয়, তার বিরুদ্ধে ৫জন মুসলিম নারী সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করেছিলেন।
তারই প্রেক্ষিতে এক সাংবিধানিক বেঞ্চ এই রায় দিয়েছে।
এই রায় নিয়ে আজ সারা দেশেই ব্যাপক চর্চা হচ্ছে – আলোচনা চলছে মুসলমান প্রধান এলাকাগুলোতেও। বাদ নেই কলকাতাও।
কলকাতার অন্যতম মুসলিম প্রধান এলাকা পার্ক সার্কাস লাগোয় এন্টালি-পদ্মপুকুরে গিয়েছিলাম সন্ধ্যের মুখে।
ব্যস্ত রাস্তায় রিকশা – গাড়ি – মোটরসাইকেলের বিরাম নেই। কাছের মসজিদ থেকে নামাজের আজান শোনা যাচ্ছে। অনেকেই নামাজ পড়তে যাচ্ছেন, আবার অনেকে পাড়ার মোড়ে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছেন।
সেখানে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে তিন তালাক নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে আলোচনা।দেখা হল এক শিক্ষক, মুহম্মদ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে। ডেকে নিয়ে গেলেন ঘরের ভেতরে।
জানতে চেয়েছিলাম সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কীভাবে দেখছেন?
” বি জে পি সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিষয়টাকে তুলে এনেছে। তারা চাইছে আমাদের পারিবারিক আইনে হস্তক্ষেপ করতে। কিন্তু দেখানো হচ্ছে যে মুসলিম মহিলারা এই প্রথার ভিক্টিম হচ্ছেন। কিন্তু বিচ্ছেদ কোন সমাজে, কোন ধর্মে হয় না বলুন তো? হিসাব করলে দেখা যাবে অন্যান্য ধর্মের থেকে মুসলিম সমাজে তালাকের হার কম,” বলছিলেন মি. সাহাবুদ্দিন।
সেখানে হাজির ছিলেন ক্যারাটে প্রশিক্ষক এম এ আলি আর আর্শাদ হুসেইন।
মি. আলি বলছিলেন, “আমার তো মনে হয় তালাক শব্দটাই তুলে দেওয়া উচিত। আমার মা-বোনের ঘর কেন নষ্ট হবে? শুধু মুখে বলে দিলাম আর বিচ্ছেদ হয়ে গেল? হতেই পারে কোনও নেশা না করে এমনিই বলেছি, হতে পারে তার পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে, কিন্তু সংসারটা তো ভেঙ্গে গেল! এটা কোথাকার নিয়ম, কোথাকার শিক্ষা?”মি. হুসেইন যেটা বলছিলেন, তা হল, তিন তালাক প্রথা শরিয়তে রয়েছে আজ থেকে না, ১৪০০ বছর ধরে.. এটা কোনও মানুষের তৈরি আইন নয়। সেটা কেউ বদলাতে পারবে না। গোটা পৃথিবীও যদি এক হয়ে গিয়ে চেষ্টা করে এই নিয়ম পাল্টাতে সেটা সম্ভব না। সে নিজে বদলে যাবে, তবুও শরিয়ত বদল করতে পারবে না কেউ।
“বি জে পি সরকার কিছু কম বুদ্ধি সম্পন্ন – সভ্যতা ভব্যতা না জানা কিছু নারীকে জড়ো করে তাদের দিয়ে কিছু বলালো আর শরিয়তের আইন পাল্টে গেল – তা কিছুতেই হবে না। সুপ্রিম কোর্টকে এই রায় বদলাতেই হবে। চারদিক থেকে এমন চাপ তৈরি হবে – দেখবেন আদালত তার রায় বদল করতে বাধ্য হবে,” বলছিলেন মি. হুসেইন।
রাস্তার অন্যদিকে একটা গলির ভেতরে থাকেন সালেহা তাবাস্সুম।
টেলিভিশনে সারাদিন ধরে দেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে প্রতিবেদনগুলি।
জানতে চেয়েছিলাম, তাঁর নিশ্চয়ই এমন অনেক চেনা পরিচিত নারী আছেন, যাঁদের স্বামীরা পর পর তিনবার তালাক উচ্চারণ করে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন?হ্যাঁ, অনেকেই আছে সেরকম। আসলে বিষয়টা হল তিন তালাক শরিয়তে যেভাবে আছে, অনেকে তো সেটা মানে না। হোয়াটসঅ্যাপ বা ফোনে পর পর তালাক বলে দেয়। এটা জায়েজ না, সেটা মানা যাবে না। আর এভাবে হঠাৎ করে তালাক দিয়ে দেওয়ার পরে সেই মেয়েদের সংসারটা তো নষ্ট হয়েই যায়, তাদের খুব স্ট্রাগলও করতে হয়। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় অনেককে, বলে যে তার আর ওই বাড়িতে থাকার অধিকার নেই,” জানাচ্ছিলেন মিসেস তাবাস্সুম।
মিসেস তাবাস্সুমের আত্মীয়া আনিসা আফরোজও হাজির ছিলেন সেখানে। তিনি বলছিলেন অনেকেই শরিয়তে উল্লেখ করা পদ্ধতি না মেনেই পর পর তিনবার তালাক উচ্চারণ করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেন। সেটা তো বে নিয়ম। একেকবার তালাক বলার পরে সময় দিতে হবে তার মধ্যে যদি স্বামী স্ত্রীর বোঝাপড়া হয়ে যায় ঠিক আছে। না হলে শেষমেশ বিচ্ছেদের রাস্তা তো খোলা আছেই। বহু লোকই এটা মানে না। পর পর তালাক বলেই বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয় – এটা হয় নাকি !!”
তিনি আরও বলছিলেন যে শুধু দুটো জীবনের তো বিষয় না, সন্তানদের কথাও তো ভাবতে হবে – বাপ মায়ের সঙ্গে বাচ্চাদের জীবনও তো নষ্ট হয়ে যায়।
যখন ফেরার রাস্তা ধরেছি, তখন অদ্ভুতভাবে চোখে পড়ল দুজন হিজাব পরিহিতা নারী কথা বলছিলেন ওই ক্যারাটে প্রশিক্ষকের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে দুতিনটি বাচ্চা মেয়ে – তারা ক্যারাটে শিখতে চায়।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031