নবেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) তুন পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে । একই সঙ্গে আবেদনপত্র সত্যায়ন ও প্রত্যয়ন বিধানও বাতিল চেয়েছে সংস্থাটি। টিআইবি বলছে, পুলিশি তদন্তে সেবাগ্রহীতাদের ৭৬.২ শতাংশ অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছেন এবং ৭০.৩ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে পুলিশকে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিসে সেবাগ্রহীতাদের গড়ে ২২১০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। আর পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে গড়ে দিতে হয়েছে ৭৯৭ টাকা। গতকাল ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘পাসপোর্ট সেবায় সুশাসন: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপরসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সদস্য এম. হাফিজ উদ্দিন খান, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। পাসপোর্ট পেতে নাগরিকরা দীর্ঘদিন ধরেই ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। এ সত্য অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু তাই বলে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের দাবির যথার্থতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ এতে রোহিঙ্গাসহ অন্যদেশের নাগরিকদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়ে যাওয়ার সম্ভানা থেকে যাবে। টিআইবি ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত এই গবেষণা কার্যক্রম চালায়। প্রতিটি বিভাগে জেলা পর্যায়ে মোট ১ হাজার ৪৫৩ জন জরিপে অংশ নেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, গবেষণা প্রতিবেদনে আমরা দেখিয়েছি, পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানি হচ্ছে; এটার কোনো দরকারই নেই। এর বদলে সকল নাগরিকের জন্য ‘বায়োমেট্রিক ডাটা ব্যাংক’ এবং ‘অপরাধী তথ্য ভাণ্ডার’ তৈরি করে তার সঙ্গে পাসপোর্ট অফিস ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের সংযোগ স্থাপন করার সুপারিশ করেন তিনি। তিনি বলেন, গ্রাহকের তথ্য যাচাইয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নিয়ম তুলে দেয়ার পক্ষে পুলিশসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাংশ সম্মত রয়েছেন। কিন্তু আরেক অংশ এই নিয়ম বহাল রাখতে চান। এ কারণে ভেরিফিকেশন প্রথা তুলে দেয়া যাচ্ছে না। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের হয়রানি বন্ধে পুলিশ ভেরিফিকেশন ও সত্যায়নের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
গবেষণা প্রতিবেদনের উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহনূর রহমান। তিনি বলেন, পাসপোর্ট করাতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয় পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি), তাদের ভেরিফিকেশনের জন্য। জরিপে অংশগ্রহণকরীরা বলেছেন, পুলিশের ওই দপ্তর ‘অযথা’ আবেদনপত্রে ত্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। জঙ্গি কার্যক্রম বা অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সন্দেহের কথা বলে ভয় দেখায়। বাড়িতে না গিয়ে চায়ের দোকান বা থানায় ডেকে পাঠায়। ঘুষ দাবি করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা বিকাশের মাধ্যমে পাঠাতে বলে।
দেশের ৬৭টি পাসপোর্ট অফিসের মধ্যে বিভাগ অনুপাতে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ২৬টি পাসপোর্ট অফিস নির্বাচন করে প্রতি অফিসে ৫ কর্মদিবস করে জরিপ চালিয়েছে টিআইবি। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৫.২ শতাংশ পাসপোর্ট সংশ্লিষ্ট কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। এর মধ্যে ৪৫.৩ শতাংশ ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন। আর ২৭ শতাংশ উত্তারদাতা অযথা সময়ক্ষেপণের শিকার হওয়ার এবং ২.২ শতাংশ পাসপোর্টগ্রহীতা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কথা বলেছেন।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৭৬.২ শতাংশ উত্তরদাতা এ কাজের জন্য অনিয়ম ও হয়ারানির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। ৭৫.৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাদের গড়ে ৭৯৭ টাকা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত টাকা পুলিশকে দিতে হয়েছে ভেরিফিকেশনের জন্য।
টিআইবি বলছে, পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি আগের তুলনায় কমেছে। ২০১৫ সালে টিআইবির জাতীয় খানা জরিপে ৭৭.৭ শতাংশ উত্তরদাতা পাসপোর্ট করাতে গিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছিলেন। ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেয়ার কথা বলেছিলেন ৭৬.১ শতাংশ উত্তরদাতা।
জরিপে অনুযায়ী, পাসপোর্ট অফিস থেকে দেয়া স্লিপে উল্লেখ করা নির্ধারিত সময়ে অনেকেই পাসপোর্ট পাচ্ছেন না। ২৭ শতাংশ বলেছে, তাদের ১২ দিন বেশি সময় লেগেছে। আর সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে ৪১.৭ শতাংশ পাসপোর্ট করার সময় দালাল বা অন্যান্যের সাহায্য নিয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ দালালের সহযোগিতা নিয়েছে। এই সহযোগিতা নেয়ার হার সবচেয়ে বেশি সিলেটে। এই সংখ্যা ৬০ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম রাজশাহীতে ২০ শতাংশ। এ ছাড়া ময়মনসিংহে ৫৬%, চট্টগ্রামে ৫৫%, ঢাকায় ৪৭%, বরিশালে ৩৭%, খুলনায় ৩৫% এবং রংপুরে ২৩% শতাংশ সেবাগ্রহীতা দালালের সহযোগিতা নিয়েছেন। গবেষণা অনুযায়ী জরিপের আওতাভুক্ত প্রায় সব পাসপোর্ট অফিসেই (অভ্যন্তরে ও বাইরে) দালালের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। দালালদের একাংশ এসবি পুলিশ এবং পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। দালালদের একাংশ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং স্থানীয় প্রভাব শালীদের ছত্রছায়ায় তাদের দৌরাত্ম্য বজায় রাখে।
গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০১৫ সালের তুলনায় দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। তবে এখনও পাসপোর্ট করতে গিয়ে বিদেশগামী শ্রমিকরাসহ সাধারণ মানুষ সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হচ্ছেন।
এদিকে, পাসপোর্ট নবায়নের মেয়াদ ১০ বছর করার সুপারিশ করেছে টিআইবি। সংস্থাটির মতে, বর্তমানে ৫ বছর পর পর পাসপোর্ট নবায়ন করতে গিয়ে গ্রাহকদের দুর্নীতির শিকার হতে হয়। মেয়াদ বাড়িয়ে ১০ বছর করা হলে এমনিতেই দুর্নীতি কমে যাবে।
গবেষণার সার্বিক দিক নিয়ে সুলতানা কামাল বলেন, সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে এই ভেরিফিকেশনের বিষয়টি চলে আসছে। আগে কোনো কিছু করতে হলেই বলা হতো- পুলিশের কাছে থেকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট লাগবে। সেখানে লেখা থাকত- ‘ওই ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত নয়’। এখন এই গণতান্ত্রিক সময়েও জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের যে অবিশ্বাস সেটা রয়ে গেছে। তিনি বলেন, জনগণের প্রতিনিধি বলে যারা নিজেদের দাবি করেন, তারা জনগণকে বিশ্বাস করেন না। অপরাধী কে সেটা পুলিশ জানে। যখন ধরা পড়ে তখন দেখা যায় সে দশ বছর ধরে অপরাধী। তার মানে পুলিশ জানত, কিন্তু দেখত না। যখনই সাধারণ মানুষের বিষয় আসে, তখন দেখা যায় পুলিশ খুব তৎপর।
পাসপোর্ট অফিসগুলোকে ঘিরে দালালদের উৎপাত ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে থেকেই কর্মকর্তারা দুর্নীতি প্রশ্রয় দেন, এ কারণেই দালালদের তৎপরতা বন্ধ করা যায় না। তিনি অভিযোগ করেন, বিভিন্ন কাগজপত্র সত্যায়িত করার জন্য অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাইরের ফটোকপির দোকানের যোগাসাজশ রয়েছে।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |