সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দুপুরে শহীদ মিনারে নেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের জনপ্রিয় কিংবদন্তি নায়ক রাজ্জাকের মরদেহ।
একজন সাধারণ মানুষ আবদুর রাজ্জাক চলচ্চিত্রে নাম লিখিয়ে পরিচিত হন রাজ্জাক নামে। চলচ্চিত্রের পথচলায় একের পর এক সাফল্যকে মুঠোবন্দি করতে করতে একসময় তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য এক মানুষ। তার অভিনয়ের ঔজ্জ্বল্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। অভাবনীয় সাফল্যের গুণে তিনি ভূষিত হন ‘নায়করাজ’ উপাধিতে। আর এ উপাধি তাকে দিয়েছিলেন প্রয়াত খ্যাতিমান সাংবাদিক চিত্রালি সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী। বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে প্রায় তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন এ বরেণ্য অভিনেতা। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘বাদি থেকে বেগম’, ‘সমাধি, ‘কি যে করি’, ‘বেঈমান’, ‘এতটুকু আশা’, ‘নাচের পুতুল’, ‘পিচঢালা পথ’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘অভিযান’, ‘বদনাম’, ‘অমর প্রেম’, ‘আনারকলি’, ‘আবির্ভাব’, ‘দ্বীপ নেভে নাই’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘সুখে থাকো’, ‘মাটির ঘর’, ‘সাধু শয়তান’, ‘অবুঝ মন’, ‘অলংকার’, ‘আসামী’, ‘রংবাজ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘বড় ভালো লোক ছিলো’, ‘অনুরাগ’, ‘মৌ চোর’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, ‘শুভদা’, ‘স্বরলিপি’, ‘মধূমিলন’, ‘মনের মতো বউ’, ‘ময়নামতি’ প্রভৃতি। ঢাকাই ছবিতে নায়ক হিসেবে নায়করাজ অভিনীত প্রথম সিনেমা জহির রায়হান নির্মিত ‘বেহুলা’। এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন সুচন্দা। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মোট ১৮ জন নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করেছেন তিনি। সবচেয়ে বেশি করেছেন নায়িকা শাবানার বিপরীতে ৪০টি ছবিতে। এ তালিকায় দ্বিতীয় হচ্ছেন ববিতা। তার সঙ্গে অভিনীত ছবির সংখ্যা ৩৯টি। রাজ্জাক ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। নায়ক হিসেবে তার অভিনীত শেষ ছবি ‘মালামতি’। এতে নায়িকা ছিলেন নূতন। নায়ক চরিত্রের বাইরে তিনি অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন ১৯৯৫ সাল থেকে। তার প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র ১৯৭৭ সালে ‘অনন্ত প্রেম’। এতে তার নায়িকা ছিলেন ববিতা। নায়িকা কবরীর সঙ্গে তৈরি হয়েছিল নায়করাজের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবির্ভাব’ ছবিতে রাজ্জাক-কবরী জুটিকে দর্শক পর্দায় প্রথম দেখেন। এ দু’জন জুটি হয়ে বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছেন। প্রযোজকদের কাছে এ জুটির ব্যাপক চাহিদা ছিলো। তার সর্বশেষ পরিচালিত চলচ্চিত্র ২০১৪ সালে ‘আয়না কাহিনি’। তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ২০১৪ সালে ‘কার্তুজ’। চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা হলেও টেলিভিশনের প্রতি নায়করাজ রাজ্জাকের ছিল ব্যাপক আগ্রহ। ক্যারিয়ারের শুরুতে ‘ঘরোয়া’ নামের একটি টিভি নাটকে অভিনয় করে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। গত কয়েক বছর ধরে চলচ্চিত্রের কাজ কমিয়ে দিয়ে এ অভিনেতা নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন টিভি নাটক কিংবা টেলিফিল্মের সঙ্গে। বিশেষ করে ছেলে সম্রাটের নির্মাণে বেশ কটি টিভি নির্মাণে কাজ করেছেন তিনি। আর মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। দেশের পাশাপাশি কলকাতারও বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেন এ অভিনেতা। রাজ্জাক অভিনেতা, পরিচালকের পাশাপাশি ছিলেন বিশিষ্ট প্রযোজকও। অভিনয়ে তার শুরুটা হয়েছিল কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেনিতে পড়াকালীন স্বরসতী পূজায় মঞ্চ নাটকে। প্রথম অভিনীত নাটক ‘বিদ্রোহী’। ঢাকায় আসার পরও অসংখ্য মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫০টিরও বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। এ অভিনেতা চলচ্চিত্রে পথচলা শুরু করেন কলেজ জীবনে ‘রতন লাল বাঙালি’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে। এ ছাড়া কলকাতায় ‘পঙ্কতিলক’ ও ‘শিলালিপি’ নামে আরো দুটি ছবিতে অভিনয় করেন। রাজ্জাকের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩শে জানুয়ারি ভারতের দক্ষিণ কলকাতার নাকতলায়। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে স্বপরিবার ঢাকায় চলে আসেন তিনি। বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবনে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সেরা অভিনেতা হিসেবে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন রাজ্জাক। এছাড়া পেয়েছেন মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৪ (আজীবন সম্মাননা), বাচসাস পুরস্কার ২০০৯ (আজীবন সম্মাননা) এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন থেকে আরো অসংখ্য পুরস্কার। চলচ্চিত্র জগতে পদার্পনের শুরু থেকে অনেকেই রাজ্জাকের চেহারার মাঝে মিল খুঁজে পেয়েছেন উত্তম কুমারের। কিন্তু নায়করাজ সচেতনভাবে কখনো তাকে অনুকরণ করেননি। যদিও তিনি ছিলেন তার দারুণ ভক্ত। তাকে শ্রদ্ধাও করতেন খুউব। কিন্তু তাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেননি কখনো। তিনি তার নিজস্ব স্টাইলেই অভিনয় করে গেছেন সারাজীবন।