চট্টগ্রামে পথে-ঘাটে, হাটে-মাঠে, আবাসিকে, মার্কেটে যত্রতত্র কিন্ডার গার্টেন, এমপিও-ননএমপিও স্কুল- কলেজের ছড়াছড়ি। অনুমোদিত-অননুমোদিত এসব স্কুলের বেশিরভাগই দশম শ্রেণী পর্যন্ত হলেও লাগানো হয়েছে স্কুল এন্ড কলেজের সাইনবোর্ড।
এইচএসসি পর্যন্তগুলোতে ঝুলছে কলেজ এন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড। যেগুলোতে নেই শিক্ষার কোনো অবকাঠামো। নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক। হচ্ছে না প্রয়োজনীয় পাঠদান। পড়াশোনা বলতে কিছুই হচ্ছে না। বরং শিক্ষার্থীদের টেনে নেওয়া হচ্ছে শিক্ষকদের পরিচালিত বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট ব্যাচে। যেখানে হয় সব পড়াশোনা।
এমন তথ্য জানালেন চট্টগ্রামের চকবাজারসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তাদের কেউ পরিচতি প্রকাশে রাজী নয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর এক কথা, নাম জানলে কপালে আর পাশ জুটবে না।
শিক্ষার্থীরা জানান, শুধু কেজি স্কুল বা এমপিও-ননএমপিও নয়, খোদ নগরীর সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরাও এসবের সাথে জড়িত। ফলে ক্লাশে নিয়মিত না হলেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যাচ্ছে শিক্ষকদের বদন্যতার কারণে।
জানা গেছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম রোধে ডিজিটাল নজরদারির আওতায় আসার কথা ছিলো চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।এজন্য চালু করা হয়েছিলো,এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা ইএমএস। গত বছরের জুলাইয়ে জেলা প্রশাসন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়।
এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রমে অনেক বেশি গতি আসবে বলে মনে করেছিলেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ালেখার মান নির্ণয়ের বড় নিয়ামক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি। যা ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ বহু পুরনো। তাই এই গড়হাজিরা রোধেই জেলা প্রশাসনের এই ইএমএস কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্টরা তখন বলেছিলেন, এই কার্যক্রমের আওতাভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানকে এক জায়গায় বসে মনিটরিং করা যাবে। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকবে ডিজিটাল আইডি কার্ড ও ফিঙ্গার প্রিন্টের ব্যবস্থা। ফলে নিশ্চিত হবে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ।
জানা গেছে, প্রথম পর্যায়ে এই কার্যক্রম চালু করা হয়েছে জেলা ও মহানগরের নয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছিলেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। পর্যায়ক্রমে ইএমএস সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালু হবে বলে জানানো হয়েছিলো তখন। কিন্তু তা আর হয়নি। তারপরও দীর্ঘদিনের অভিযোগ এটাই, কতিপয় শিক্ষক নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান অস¤পূর্ণ রেখে বিভিন্ন কায়দা-কানুন করে শিক্ষার্থীদের তার পরিচালিত কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট ব্যাচে যেতে বাধ্য করেন। তারা সরকারি টাকায় বেতন নিলেও উপরি আয়ের ব্যাপারে কোনভাবেই ছাড় দেয় না। আর এই প্রাইভেট ব্যাচ-কোচিং বাণিজ্যকে ঘিরে শিক্ষকদের পরীক্ষার খাতায় নাম্বার কম দেওয়া, কিছু ক্ষেত্রে ফেল করিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে হরহামেশাই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত, হিসাববিজ্ঞান ও ইংরেজি, বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি ও গণিত, কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি, গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞান, মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলে গণিত ও ইংরেজি, নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজী ও গণিত, সরকারি মুসলিম উ বিদ্যালয়ে ইংরেজি, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান, হাজী মুহাম্মদ মহসিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজি, গণিত ও হিসাব বিজ্ঞান, কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজি ও বাংলা, চট্টগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গণিত ও ইংরেজি, ডা. খাস্তগীর উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও ইংরেজি বিষয়ের কতিপয় শিক্ষক কোচিং বা প্রাইভেট পরিচালনা করছেন।
এছাড়া নগরীর চকবাজার গুলজার টাওয়ার, মতি টাওয়ার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ভবনসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে শত শত কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট ব্যাচ প্রতিষ্ঠান। যেখানে সকাল-বিকেল হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পদচারনা লক্ষ্য করা গেছে।
শিক্ষার্থীদের মতে, আর দুই মাস পরেই জেএসসি পরীক্ষা। এর পর শুরু হবে পিএসসি পরীক্ষা। পিএসসি পরেই শুরু হবে এসএসসি পরীক্ষা। এই কয়েকটি বোর্ড পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে নগরীর বেশ কয়েকটি স্কুলে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে স্পেশাল কোচিং বাণিজ্য। এছাড়া মডেল টেস্টের নামেও অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবছর পরীক্ষার মৌসুম এলেই স্কুলগুলোর এই স্পেশাল কোচিং-মডেল টেস্ট বাণিজ্য শুরু হয়। স্কুলভেদে টাকার অংকে হয়তো কম-বেশি হয়, কিন্তু পরীক্ষার মৌসুম এলেই এই মৌসুমী কোচিং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বলতে গেলে কোন স্কুলই পিছিয়ে থাকে না।
এতে অংশ নিতে না চাইলেও শিক্ষার্থীকে একরকম বাধ্যতামূলকভাবেই টাকা দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে, মূল ক্লাস বন্ধ রেখে ওই সময়টাতেই একই শিক্ষক একই বিষয় নিয়ে পড়িয়ে থাকেন। আর কোচিং এর মোড়কে এই এক্সট্রা ক্লাসের জন্য অতিরিক্ত অর্থের যোগান দিতে দুর্ভোগে পড়তে হয় মধ্যবিত্ত অভিভাবকদের।
শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য নিষিদ্ধ করে সরকারের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে নীতিমালা চূড়ান্ত করা হলেও তা মানা হচ্ছে না কোথাও। ২০১২ সালের ১৪ জুন পাস হওয়া ওই নীতিমালা অনুযায়ী, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অংকের টাকা নিয়ে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরই অতিরিক্ত ক্লাস নিতে পারবেন।
নীতিমালা অনুযায়ী নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করাতে না পারলেও শিক্ষকরা দিনে অন্য প্রতিষ্ঠানের ১০ জন শিক্ষার্থীকে বাড়িতে পড়াতে পারবেন। তবে এ বিষয়ে শিক্ষককে প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছে প্রতিবেদন দিতে হবে। এক্ষেত্রে আইন ভঙ্গকারী শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিল করা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, নিজের প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে মহানগরী এলাকার প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসে ৩০০ টাকা, জেলা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২০০ টাকা এবং উপজেলা ও অন্যান্য এলাকার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দেড়শ টাকা নেওয়া যাবে। তবে এই টাকার ১০ শতাংশ বিদ্যালয়ের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস খরচ ও কর্মচারীদের জন্য রাখা হবে। বাকি টাকা শিক্ষকরা পাবেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ এই অর্থ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে। কারা, কীভাবে, কোথায় কোচিং বাণিজ্য করছে- তা খতিয়ে দেখতে সে সময় (২০১২ সালে) একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিলো। সেই কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকেই নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এ নীতিমালার আলোকে শিক্ষকরা ক্লাসের দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। তবে কোনো শিক্ষার্থীকে ক্লাস করতে বাধ্য করা যাবে না। অভিভাবকের মতামতের ভিত্তিতেই এ ক্লাস নিতে হবে। কিন্তু এ বিষয়টি কোন স্কুলেই মানা হয় না।
চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মাহবুবা বেগম জানান, ২০১২ সালে এ সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি নীতিমালা হওয়ার আগে এই স্কুলের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতেন। তবে এখন এখানকার শিক্ষকরা প্রাইভেট বা কোচিং করান না।
ডা. খাস্তগীর সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হাসমত জাহান বলেন, এখানকার কেউ প্রাইভেট পড়ান এমন কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। এসএসসি উপলক্ষ্যে কোচিং হবে না। তবে মডেল টেস্ট হতে পারে।
জেলা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উপসহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম বলেন, মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সম্মানের চোখে দেখলেও অধিকাংশ শিক্ষক প্রাইভেট-কোচিংসহ নানা অনৈতিক কাজে জড়িত। সংঘবদ্ধ বলে তারা কোন নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করেন না। এ ব্যাপারে তাগাদা দিলে তারা শিক্ষা কর্মকর্তাদের পর্যন্ত কলুষিত করে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা হারুনর রশিদ বলেন, নগরীর সিংহভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রাইভেট ও কোচিংয়ের সাথে জড়িত। বিশেষ করে নারী শিক্ষকগুলো শ্রেণীকক্ষে পড়ায় না। ঘরে গিয়ে প্রাইভেট পড়ায়। কেউ কেউ নিজ বাসায় ব্যাচ পড়ায়। এগুলো নিয়ে বললে শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে।
কেজি স্কুল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একই অবস্থা। ক্লাসে পাঠদান হয় না। প্রাইভেট কোচিংয়েই হয় সব পড়াশোনা।