ফরহাদ মজহারের পরিচয় আসলে কী? এক কথায় বলা মুশকিল। সাংবাদিক, কবি কিংবা বুদ্ধিজীবী-লেখকের তকমা কি তার জন্য যথেষ্ট? এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক একটা অংশ দীর্ঘদিন ফরহাদ মজহারের ভক্তিতে নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছিলেন। রেখেছিলেন বললাম এ কারণে, এখন এই ভক্তকুলের একটা বড় অংশ ভক্তি সরিয়ে নিয়েছেন কিংবা অতীতের ভক্তি নিয়ে মনোবেদনায় আছেন। কারণ সম্প্রতি অর্চনা রানী নামের এক তরুণীর সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের কাহিনী জনসম্মুখে প্রকাশিত হলে ফরহাদ মজহারের জীবনের আরেক দিক উন্মোচিত হয়। কিন্তু ফরহাদ মজহার যে বছর কয়েক ধরে বাংলাদেশে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কায়েম করার জন্য জিহাদের আহবান করে আসছিলেন! লন্ডনে গিয়ে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে লন্ডনের ওয়াটার লিলি গার্ডেনে সিটিজেন্স মুভমেন্ট ইউকে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় নিজের ভাষণে তুলে ধরেছেন কিভাবে ২০১৩ সালের ৫ ই মে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিলেন। বলেছেন, সরকার সেদিনই উৎখাত হত, যদি তার পরিকল্পনা সফল হত। তিনি এও বলেছেন, শুধু নির্বাচন দিয়ে এই সরকারকে বাংলাদেশ থেকে সরানো যাবেনা। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশ নিয়ে দেশজুড়ে তিনি এবং আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মিলে কীভাবে উল্টো প্রচার চালিয়ে হেফাজতে ইসলামের মত একটি শক্তির জন্ম দিয়েছেন সেই কৃতিত্বগাঁথাও তিনি এই ভাষণে বিধৃত করেছেন। তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করতে বলেছেন।আবার খালেদা জিয়া এখন দুই মাসের লন্ডন সফরে আছেন। ফলে ফরহাদ মজহারের ভাষণ খুবই প্রাসঙ্গিক।এর আগে ফরহাদ মজহারের ভাষণের লিখিত রূপের প্রথম কিস্তি গিয়েছে। আজ দ্বিতীয় কিস্তি দেয়া হল। ফরহাদ মজহার সে ভাষণে বলেছেন-
“এত বড় ব্যাপার, টেলিভিশনে ছবি, সমস্ত কিছুর মধ্যে আমরা একজন, দুজন দাঁড়িয়ে আছি, আমরা দেখতেছি এই অদ্ভুত দৃশ্য। আমি দেশে ছিলাম না, বিদেশে ছিলাম, মাহমুদুর রহমান আমাকে টেলিফোন করে বললেন, ফরহাদ ভাই কী অবস্থা! তিনি লিখলেন, ‘ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শুনি’, আমি দেশে ফিরে আসলাম। দুঃখের কথা সে সময় এমনকি, জাতীয়তাবাদী অনেক শক্তির মধ্যে অনেক নেতাকে দেখেছি,শাহবাগের পক্ষে যাচ্ছেন, খালেদা জিয়াকে যদি আমি বন্ধ না করতাম তিনিও হয়ত এর পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতেন (এসময় উপস্থিত লোকজনের মধ্যে হাসির রোল উঠে)। দুঃখজনক এটা। আমরা দুইটা মানুষ একা, আমরা দুইটা মানুষ একা। বিশাল তাদের সমাবেশ। আমরা দাঁড়িয়েছে, আমরা বলেছি এটা ফ্যসিবাদ, এটা অসুস্থতা, এটা প্যাথলজি, এরা আধুনিক কেউ না, এদের মধ্যে আধুনিকতা নাই। কারণ যারা ফাঁসি চায়, এবং ফাঁসি দেখে মোমবাতি জ্বালায়, এটা অদ্ভুত ব্যাপার, এর চেয়ে অসুস্থতা পৃথিবীতে আর দেখবেন না। পৃথিবীর কোথাও আপনি দেখবেন না যে, তরুণ ছেলেরা যারা নিজেদের আধুনিক বলে দাবি করে, প্রগতিশীল বলে দাবি করে তারা এরকম ফাঁসি ফাঁসি করে, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের মধ্যে (কপালে হাত দিয়ে ইংগিত করে) ফাঁসির ট্যাগ লাগায়, বাচ্চাদেরকে ফাঁসি ফাঁসি শেখায়, যে বাচ্চা জানেনা ফাঁসি কী জিনিস।
তাহলে এই একটা অবস্থার মধ্যে আমরা পড়েছি। তাহলে আমরা একজন কি দুইজন আমরা তাদেরকে রুখে দিয়েছি, আমরা তাদের ভয় পাই নাই (ঠিক ঠিক বলে উপস্থিত লোকজন চিৎকার করে উঠে)। তাসের ঘরের মত পড়ে গেছে, তাসের ঘরের মত, তার কোনো ট্রেস নাই। কিন্তু তখন আমাদেরকে বলা হত, আমার লেখা যারা পড়েছেন, এরা তরুণ প্রজন্ম। আমি বলি তরুণ খালি তোমরা, মাদ্রাসায় যারা পড়ে তারা তরুণ না, তারা বুড়া হয়ে গেছে (হাসির রোল)। আমি লিখেছিলাম, আপনারা যারা পড়েছেন তারা দেখেছেন। তোমাদের চোখে যারা তরুণ, এরাতো বৃদ্ধ চিন্তাতে, এরা অসুস্থ।সত্যিকারের তরুণ তো সে ছেলে যে হেঁটে এসেছে চিড়া আর গুড় নিয়া, তোমাদেরকে প্রতিবাদ করার জন্য। হেঁটে এসেছে, আমি জানি কুমিল্লা থেকে হেঁটে এসেছে, সেই হাটহাজারি থেকে হেঁটে এসেছে, সেই বিভিন্ন জায়গা থেকে, ফরিদপুর থেকে, উত্তরবঙ্গ থেকে বগুড়া থেকে হেঁটে এসেছে। আপনারা যদি সেই দৃশ্য দেখেছি, হেঁটে হেঁটে; মানুষ তাদেরকে পানি দিয়েছে, মেয়েরা তাদের জন্য খাওয়া পাক করছে। লোকে দিচ্ছে, মানুষের মনে বেদনা, মানুষের মনে দুঃখ; তারা তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমরা সফল হতে পারিনি। এই সরকার তখনই পতন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আমরা কেন পতন করতে পারি নাই? কারণ আমাদের মধ্যে ষড়যন্ত্রবাদীরা আছে (ঠিক ঠিক বলে সবাই চিৎকার করে উঠে)। আমরা সেই সময় প্রত্যেকেই চেয়েছি, এই পদযাত্রা, বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে শহরকে ঘিরে ফেলা, একই সঙ্গে বিএনপি, একই স্থানে সভা দেবে, যাতে সারা পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারে, এটা একটা গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণের; তারা তাদের প্রতিবাদ জানাতে এসেছে। এদের বিরুদ্ধে প্রচারিত হল এই, এই হেফাজতিরা, এই জামাতি ইসলামিরা একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে একটা ষড়যন্ত্র করছে বাংলাদেশে। এবং সেটাকে ঠেকানোর জন্য দেখা গেল, যারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী শক্তি বলছেন তাদের একটা অংশ, এটার রসদ যোগাচ্ছে, এই প্রচারের, এই গুজবের। আমরা বললাম যে, জাতীয়তাবাদী শক্তি যারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশকে ভালোবাসে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ভালোবাসে, তাদের উচিত ঐক্যবদ্ধ থাকা, একসময় একই তারিখে কর্মসূচি দেয়া। এই যে কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা এই শক্তিকে বুঝিয়ে দিতে পারি যে আমরা সমস্ত জাতি, সমস্ত জনগণ ঐক্যবদ্ধ আছি। যদি একই তারিখে এটা হত, ৫ ই মে এর ঘটনা, তাহলে আজকে বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে যেত (বিশাল চিৎকার আসে সমবেত লোকজন থেকে)। চারদিকের ইতিহাস আপনারা জানেন। চার তারিখে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা দিয়েছেন, আপনারা কি আমার সঙ্গে বসবেন? আমি আপনাদেরকে সেই দিনের খবরের কাগজ পড়ে, অনুরোধ করব, দেখবেন কারা কারা বলেছেন ‘না’। আমি আর কিছু বলব না। উনি পারেন নাই। আমি বলব, যেহেতু আমি সাক্ষী, যে বেগম খালেদা জিয়া, তিনি বুঝেছেন যে, এই ধরনের সরকারকে, শুধুমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সরাতে পারবেন না।
বাংলাদেশের সংকটটা নির্বাচনের সংকট নয়। বাংলাদেশের সংকটটা একটা ফ্যাসিবাদী সরকারকে উৎখাতের সমস্যা। আমাদের ঘাড়ের উপর বসে রয়েছে। আপনি এই যে সংবিধান, তুহিন মালিক বললেন, এই সংবিধানকে রেখে কী করে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক পথে নিয়ে যাবেন? সংবিধানটাও ফ্যাসিস্ট। সংবিধানকে ফেলে দেয়া ছাড়া আপনার সামনে আর কোনো পথ নাই, যদি আপনি গণতন্ত্র চান। কোনো সুস্থ মানুষ, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ যদি মনে করে শুধুমাত্র একটা নির্বাচনের মাধ্যমে, বাংলাদেশে বর্তমান সংবিধান যেভাবে আছে, এটা রেখে তারা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে পারবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। কিন্তু এই প্রচারটা আছে যে এই জাতীয়তাবাদী শক্তি, আমাদের মধ্যেও আছে, বিভ্রান্তি আছে। এটা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমি কারো বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাইনা। সমালোচনা আমাদের কাজ না। আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে চাই। ফলে যারা বিভ্রান্ত আছেন এখনো, যারা ভুল পথে আছেন এখনো, যারা নেতৃত্বকে, যারা নেতৃত্ব দিতে চান, যারা বেগম খালেদা জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করতে চান, তারা আসবেন, সকলের কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা” (চলবে)।
লেখকঃ গবেষক ও সাংবাদিক