ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় একসময়ের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স (এমইবি)। অনিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ ও পারিবারিক দ্বন্দ্বে ব্যবসায়িকভাবে ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকে ১৯৪৬ সালে ব্যবসা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি। ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে একের পর এক তা খেলাপি হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি টাকার বেশি। সম্প্রতি সংসদে প্রকাশিত দেশের শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির তালিকায় প্রথম নামটিই ইলিয়াছ ব্রাদার্সের।
২০১৫ সালে বড় গ্রাহকদের ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। শর্ত হিসেবে ঋণের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার কম হলে ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিতে হতো ২ শতাংশ। ১ হাজার কোটি টাকা ও তার বেশি অংকের ঋণের জন্য এককালীন জমার হার ছিল ১ শতাংশ। কিন্তু পুঁজি সংকটের কারণে ইলিয়াছ ব্রাদার্স এ সুযোগ নিতে পারেনি। যদিও ১১টি শিল্পগ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয় ওই সময়। বেক্সিমকো, শিকদার, কেয়া, এননটেক্স, রতনপুর, এসএ, বিআর স্পিনিং ও রাইজিং গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পুনর্গঠনের এ সুবিধা গ্রহণ করে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, আমি মনে করি, যাদের ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে, তারা সবাই খেলাপি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এগিয়ে আসার কারণে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেয়া হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকের দিক বিবেচনা করে খেলাপি গ্রাহকদের যে সুবিধা দেয়া হয়েছে, তার সদ্ব্যবহার করা দরকার।
জানা গেছে, চট্টগ্রামভিত্তিক ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইলিয়াছ ব্রাদার্স ১৫টি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে ৮০১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৮০ কোটি টাকা। খেলাপি হয়ে গেছে অন্য ১০টি ব্যাংকের ঋণও। এর মধ্যে এবি ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ৬১ কোটি ৯৯ লাখ, ব্যাংক এশিয়ার ৩৬ কোটি ৮৩ লাখ, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৭১ কোটি ৮০ লাখ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৪২ কোটি ৭০ লাখ, ওয়ান ব্যাংকের ২৮ কোটি ৫৪ লাখ, পূবালী ব্যাংকের ৬ কোটি ১৯ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২২ কোটি ৪৩ লাখ ও দ্য সিটি ব্যাংকের ৫৬ কোটি টাকা।
তবে খেলাপি হয়ে যাওয়া এসব ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে বলে জানান মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্সের পরিচালক শোয়েব রিয়াদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ভোগ্যপণ্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। এ ব্যবসায় বড় অংকের লোকসানের কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে ইলিয়াছ ব্রাদার্স। বর্তমান প্রজন্ম ব্যবসা করেই ইলিয়াছ ব্রাদার্সের ৬০০-৭০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে তিন ব্যাংকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংককে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে ১৫ কোটি ও সাউথইস্ট ব্যাংককে ১২ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ আদায়ে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির নামে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে বিভিন্ন ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা আদায়ে চলতি বছরের শুরুর দিকে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা করে ব্যাংকটি। আগ্রাবাদ শাখার ঋণ আদায়ে ইলিয়াছ ব্রাদার্সের নামে ২০১৩ সালে মামলা করে এনসিসি ব্যাংক। একই বছর গ্রুপটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে মার্কেন্টাইল, দ্য সিটি, ব্যাংক এশিয়া, ওয়ান ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। খেলাপি ঋণ আদায়ে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করে আরো দুটি ব্যাংক। ব্যাংক দুটি হলো ইসলামী ও স্ট্যান্ডার্ড।
মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, প্রতিষ্ঠানটির কাছে থাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা চলছে। কিছু টাকা আমরা দ্রুত আদায় করতে পারব বলে মনে হচ্ছে।
জানা যায়, ভোগ্যপণ্যের মাধ্যমে ব্যবসায় আসা মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স স্বাধীনতার আগে-পরে দেশের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় নেতৃত্ব দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী ইউনিলিভারের প্রধান পরিবেশক হয়ে ব্যবসা করে প্রায় তিন যুগ। গেল এক দশক থেকে ইউনিলিভারের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে বিভিন্ন শিল্প গড়ে তোলে মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স। এর মধ্যে দাদা সয়াবিন তেল, ড্রিংকিং ওয়াটার, গ্লাস, নিটিংসহ একাধিক ব্যবসা শুরু করে গ্রুপটি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসায় লোকসানের পাশাপাশি কর্ণধারদের পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে গ্রুপটির আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে মোহাম্মদ ইলিয়াছ তার ভাইকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে গ্রুপটির মালিকানায় আসেন দুই ভাইয়ের সন্তান। তাদের সন্তানদের মধ্যে ব্যবসায়িক মনোভাব ছিল কম। এছাড়া সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে গ্রুপটির কর্ণধার দুই ভাইয়ের সন্তানরা আলাদা হয়ে পড়েন। বিশেষ করে মোহাম্মদ ইলিয়াছের বড় ছেলে মোহাম্মদ শামসুল আলম ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচন করেন। পরবর্তীতে ব্যবসা ছেড়ে রাজনীতিতেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি। এ সময় ব্যবসায় হাল ধরার মতো যোগ্য উত্তরসূরি না থাকায় ব্যবসার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এ দুরবস্থায় কয়েক বছর আগে গ্রুপটির হাল ধরেন প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইলিয়াছের নাতি শোয়েব রিয়াদ। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন এ তরুণ উদ্যোক্তা।
তিনি বলেন, এমইবি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স নামে নতুন উদ্যোগে আমরা ব্যবসা শুরু করেছি। তবে ব্যবসা করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসহ সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ ব্যবসায় না থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের এ ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এসব ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবসায় ফিরতে চাই আমরা।