গাড়ি ছুটে চলছে। আবছা অন্ধকার। সামনে পেছনে দু’টি গাড়ি। ওই দু’টি গাড়ির যাত্রীদের হাতে বড় বড় বন্দুক। তাক করে আছে বিভিন্ন দিকে। ভয়ে বুকটা থর থর করে কাঁপছিল। এই বুঝি আমাদের মেরে ফেলবে। এরপর গাদাগাদি করে ছোট একটি বোটে প্রায় ২০০ জনকে উঠানো হলো। চাপে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। একপর্যায়ে যাত্রা শুরু। ভয়ে শরীরে কাঁপুনি। ধীরে ধীরে বোট মহাসাগরের দিকে এগুচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখি কূল কিনারা নাই। আমাদের সঙ্গে অনেকে ভয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তাদের মেরে সাগরে ফেলা হচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে কখন কি হয়। মনে হচ্ছিলো আর বুঝি বাড়ি ফিরতে পারবো না। আর কি মা বাবার মুখ দেখতে পারবো? ভুলে যাই পৃথিবীর সবকিছু। একটাই প্রশ্ন মনে, বাঁচবো তো? বলতে গেলে যমের হাত থেকে ফিরে এসেছি। কথাগুলো বলছিলেন, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বাসিন্দা সিপার আহমেদ ও জায়েদুর রহমান। তারা উপজেলার কাদিপুর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী তুতা মিয়া ও রফিক মিয়ার সন্তান। চার মাস আগের কথা। উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নের সোবহান নুরী নামের এক দালালের সঙ্গে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকার চুক্তিতে তারা ইতালি যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কথা ছিল সেই দালাল তাদের ইতালি পৌঁছাবে। দালালের কথা মতোই ১৯শে ফেব্রুয়ারি তারা যাত্রা শুরু করে। তাদের সহযোগিতা করেন ঢাকার ফকিরাপুলের মতিন মিয়া নামের এক ট্রাভেলস এজেন্সির মালিক। মতিন মিয়া তাদের দুটি কাগজ দেন। একটি কাগজ বোডিং পাস আর আরেকটি ইমিগ্রেশন পাসের জন্য। কথা মতো তারা একটি কাগজ বোডিং পাসে এবং আরেকটি কাগজ ইমিগ্রেশনে দেখান। মতিন মিয়া তাদের বলেন, তারা দুবাইয়ে যাবার পর আরো কিছু কাগজ সেখান থেকে দেয়া হবে। পরে সেদিনই তারা রওয়ানা হোন দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে। দুবাইয়ে যাবার পর তাদের মোবাইলে আরো দুটি কাগজ দেয়া হয়। সেই কাগজ দিয়ে তারা তুরস্কের ইস্তামবুল পৌঁছান। সেখানে তাদের রিসিভ করেন এক দালাল। সেই দালাল তাদের একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। মালবাহী বড় বড় ভ্যানের পেছনে গাদাগাদি করে ঘুম পাড়িয়ে তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেয়া হতো। ইস্তামবুলের একটি অন্ধকার ঘরে তাদের রাখা হয়। সেখানে বিভিন্ন দেশের আরো অনেক লোক ছিল। কোনো পাসপোর্ট নেই। ভিসা ছিল না। কিন্তু তারা দালালদের কারণে ঠিকই এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছান। তুর্কি পৌঁছানোর পর তাদেরকে রিসিভ করে আরেক দালাল। সেখানে কিছু দিন থাকার পর আবার তাদেরকে পাঠানো হয় লিবিয়া। লিবিয়া যাওয়ার পর শুরু হয় আসল চিত্র। সেখানকার সেই করুণ চিত্র তুলে ধরেন সিপার এবং জায়েদ। তারা জানায়, লিবিয়ার মানব পাচারের ভয়ঙ্কর একাধিক চক্র কাজ করছে। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপ যেতে আগ্রহী লোকদের টার্গেট করে। তারা জানায় লিবিয়ায় তাদেরকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের বাসিন্দা নাহিন নামের এক দালাল রিসিভ করে। পরে নাহিন তাদের একটি বাসায় নিয়ে যায়। যখন তারা সেই বাসায় পৌঁছায় তখন সেখানে ২০-২৫ জন লোক ছিল। কিন্তু সময় যত যায় লোকের সংখ্যা বাড়ছিল। খোঁজ নিয়ে এবং সেই লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে তারা সোমালিয়া, ঘানা, ব্রাজিল, গ্রাব্রিয়ানসহ আরো কিছু দেশের বাসিন্দা। দালাল ধরে তারাও অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার জন্য সাগর পথে রওয়ানা হয়েছিল। কিন্তু পথিমধ্যে কিছু সন্ত্রাসীরা তাদের বোটে আক্রমণ করে। বন্দুক ধরে তাদের জিম্মি করে লিবিয়া নিয়ে এসেছে। সিপার এবং জায়েদ জানায়, কিছুদিন পর শুরু হয় আসল কাহিনী। সেই মাফিয়ারা জিম্মি করে আনা লোকদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। অন্ধকার রুমে নিয়ে তাদের মারধর করা হয়। বেধড়ক মার দিয়ে প্রথমে তাদের দুর্বল করা হয়। এরপর সেই মারধরের রক্তাক্ত চিত্র ধারণ করে তাদের পরিবারের লোকদের কাছে পাঠানো হয়। শর্ত দেয়া হয় দুইটা। বাড়ি যেতে চাইলে একরেট আর ইতালি গেলে আরেক রেট। শর্ত না মানলে তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। যে টাকা দিতে পারে না তাকে মেরে সমুদ্র ফেলে দেয়া হয়। আবার কেউ বাড়িতে ফোন দিয়ে জায়গা, সোনা বিক্রি করে টাকা এনে দিচ্ছে সেই দালালদের। পারিবারিক সচ্ছলতা বুঝে কারো কারো ওপর একাধিকবার নির্যাতন চালানো হয়। এভাবেই আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। সময় যত যায় লোক বাড়তে থাকে। ছোট ছোট একেকটি রুমে ১৫০-২০০ জনকে জিম্মি করে রাখা হতো। আর তার পাশেই টর্চার সেল। সেখানেই টাকা আদায়ের জন্য চলতো নির্মম অত্যাচার। সিপার ও জায়েদ জানায় মাফিয়াদের মারধর দেখে তাদের সবকিছু অন্ধকার হয়ে যেতো। এত অত্যাচার কি মানুষ মানুষকে করতে পারে। টাকা না পেলে তারা পশুর মতো গুলি করে হত্যা করে। পরে লাশ ফেলে দেয় সাগরে। তারা মানুষকে মানুষ মনে করে না। তাদের হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে রেহাই মিলে না। টাকা ছাড়া মাপ নাই। জিম্মিদের খাবার দেয়া হতো না।। কয়েকদিন পর পর শুকনো রুটি আর একটু পানি দেয়া হতো। এভাবেই চলতে থাকে দিন। তারপর একদিন ভোরবেলা তাদের নিয়ে রওয়ানা হয় মাফিয়া চক্র। অন্ধকারের মধ্যে মালবাহী ভ্যানের ভেতরে ঘুম পাড়িয়ে তাদেরকে নেয়া হয় সাগর পাড়ে। সেখানে জনপ্রতি ৮০ হাজার টাকা দিয়ে বোট ভাড়া করা হয়। কিন্তু বোটে উঠার সঙ্গে সঙ্গে লিক হয়ে পানি উঠা শুরু করে। পরে সেই বোট বাতিল করে আবার ৬০ হাজার করে টাকা নেয়া হয় তাদের কাছ থেকে। তারপর ইতালির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। প্রায় চার ঘণ্টা সাগরের ঢেউয়ে জীবন বাজি রেখে তাদের বোটটি পৌঁছায় মাল্টা। সেখান থেকেই ইতালির উদ্ধার কর্মীরা তাদের ফলো করছিল। ধীরে ধীরে বোটটি ইতালির উদ্ধার কর্মীদের বড় জাহাজের নিকট যায়। সেখানে আরো অনেক শরণার্থীদের বোট গিয়ে জড়ো হয়। তবে কিছু কিছু বোট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিছু কিছু বোটে পানি প্রবেশ করে ডুবে যায়। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বোটের যাত্রীদের আগে উদ্ধার করে বড় জাহাজে তোলা হয়। প্রায় ১২ ঘণ্টা পানির মধ্যে ভাসমান থাকার পর তাদের বোটের যাত্রীদের উদ্ধার করে বড় জাহাজে নেয়া হয়। সেখানে ইতালির পুলিশরা তাদের খাবার, কাপড়, ওষুধ, জুতাসহ যাবতীয় সবকিছু দেয়া হয়। পরে তাদের সবাইকে নিয়ে ইতালি শহরের একটি হোটেলে তোলা হয়। সেখানে তাদের যাবতীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। বলা হয় তারা যতদিন খুশি এখানে থাকতে পারবে। পরে তারা ইতালির এক লোকের মাধ্যমে ফ্রান্সে প্রবেশ করেন। সেখানে তারা এখন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে ফিরছেন।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |