টেকসই গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের জন্য সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জরুরি বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে একটি গোলটেবিল আলোচনায়। বক্তারা বলেছেন, সব দল অংশ নিলে নির্বাচনে কারচুপির আশঙ্কা থাকবে না।
শনিবার রাজধানীতে ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ প্রসঙ্গে এক গোলটেবিল আলোচনায় এ কথা বলেন বক্তরা। ‘ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই আলোচনার আয়োজন করে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
দীর্ঘ গোলটেবিল আলোচনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান সারাংশ টানেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হবে সেটা সংবিধানের অধীনেই হতে হবে। সেটার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। … নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হবে। সেটা লন্ডন, পাকিস্তান বা দেশের ভেতরে হতে পারে। সে বিষয়ে আমাদের সরকার সজাগ থাকবেন।’
আবদুল মান্নান বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন যদি কেউ দেখেন, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তারা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়টি পড়ে দেখতে পারেন।’
এর আগে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা প্রত্যাশা করি। …অতীতে যারা ভুল করেছেন, তারা নির্বাচনে আসুন। বাংলাদেশের ইকোনোমি উইল নট ওয়েট ফর এনিবডি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাস বেত্তা সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কাগজে কলমে আমাদের নির্বাচন কমিশন অনেক শক্তিশালী। তারা কাগুজে বাঘ থাকবে নাকি বাঘের মত হুংকার দেবে, সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। আর সরকারকে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।’
ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘অনেকেই বলেন বিএনপির পক্ষে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া অসম্ভব। তবে আমি বলি, বর্তমান সরকারের পক্ষে কি আরেকটি নির্বাচন করা সম্ভব যেখানে বিএনপি অংশগ্রহণ করতে পারবে না? তাহলে আমি বলবো, বর্তমান সরকারের দায়িত্বই বেশি। আমি মনে করি, সরকার থেকে বড় অফার যাবে তাদের কাছে।’
বিশিষ্ট আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, ‘নির্বাচন করতেই হবে, আবার এটা সুষ্ঠু হতে হবে। সবার অংশগ্রহণও জরুরি। …সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। ক্ষমতায় যদি আসতে চান, লটারি যদি জিততে চান, তাহলে তো টিকিট কিনতেই হবে। না কিনলে জিততে পারবেন না।’
সাংবাদিক নঈম নিজাম বলেন, ‘আমরা আগামী নির্বাচন সবার অংশগ্রহণ আশা করছি। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে আপসের সুযোগ থাকে না।’
‘সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সংবিধান তাদেরকে সে ক্ষমতাও দিয়ে রেখেছে। কুমিল্লায় তো ভোটের আগের দিন তারা ২৭ পুলিশ কর্মকর্তাকে পাল্টে দিয়েছিল। সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসার দায়িত্ব ইলেকশন কমিশনের ওপরই বর্তায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘নির্বাচন কেবল ইসি ও সরকারের দায়িত্ব নয়। বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দলের বস্তুনিষ্ঠ অংশগ্রহণেরও দায়িত্ব আছে। বিরোধী দল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের ফর্মুলা দিচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক থেকে সরে এসে এখন সহায়ক সরকারের কথা বলছে। যারা নির্বাচন করবে, তাদের দায়িত্বটাও ঠিক করতে হবে।’
আন্তর্জতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তুরিন আফরোজ বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেয়াও যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার, তেমনি না করাটাও গণতান্ত্রিক অধিকার। এখন একটি দল যদি নিজেরা অংশগ্রহণ না করে দেশে গণতন্ত্র নেই প্রমাণ করার চেষ্টা করে, তাহলে সেটা আমরা গ্রহণ করতে পারি না।’
তুরিন বলেন, ‘যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না, তাহলে তাদের অংশগ্রহণকে তো আমরা অংশগ্রহণ বলতেই পারি না। যারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রের সৃষ্টির সঙ্গে একমত নন, বাংলাদেশের কোনো কিছুর সঙ্গে বিশ্বাস করেন না, বা যারা সাথী হিসেবে তাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন, তারাও অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।’
বসায়ী নেতা হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অধীনে যখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে যখন, তখন দেখা গেছে প্রায় সব জায়গায় আওয়ামী লীগ হেরেছে। কারণ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে কারচুপি করার সুযোগ থাকে না। কুমিল্লায় বিএনপি বিকালে বলেছে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, কিন্তু রাতে যখন দেখা গেল তারা জিতে গেছে, তখন বলা হলো আরও বেশি ভোটে তারা জিততো। এই ধরনের অবস্থান থেকে আমরা বের হতে চাই।’
সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যদি সব দল অংশ নেয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়, তাহলে কারচুপি থাকবেই না বলে মনে হয়। এখন মিডিয়ার পাশাপাশি অলটারনেটিভ মিডিয়ার যুকে কারচুপি করে কেউ বের হয়ে যেতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘দলের ভেতর গণতন্ত্রও জরুরি। সেই সঙ্গে নির্বাচনের সময় মনোনয়ন কেনাবেচা হবে না, অসৎ, সাম্প্রদায়িক লোক মনোনয়ন পাবে না, এটাও নিশ্চিত করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জাসদ নেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কীভাবে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসবো-সে বিষয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। এটাকে আমি সুস্থ বলে মেনে নিতে পারি না। নির্বাচন কমিশনকে বলব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যাদের আছে, তাদের বিষয়ে নজর দিন। কারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন, সে বিষয়ে নজর দিন।’
মনোনয়ন নিয়ে কথা বলেন সাংস্কৃতিক কর্মী ও ব্যবসায়ী নেতা শমী কায়সারও। তিনি বলেন, ‘চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, ধর্মের নামে যারা ব্যবসা করে, যুদ্ধাপরাধীর ছেলে, ভাই আসতে পারে, সেসব ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশনকে কঠোর হতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি-এমন আদর্শ ধারণ করে, এমন কাউকে আমরা এবারের নির্বাচনে চাই না।’
শমী বলেন, ‘বলা হচ্ছে আগামী নির্বাচন হবে টাকার খেলা। এটা যেন না হয় সে জন্য ইসিকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও বিবেচনায় রাখতে হবে, যারা সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে না, দুর্নীতি করে না, নিজের স্বার্থে কাজ করে তাদের বদলে যাদের ক্লিন ইমেজ আছে, এমন প্রার্থী আমরা দেখতে চাই।’
নির্বাচন পর্যবেক্ষক নাজমুল হাসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘নির্বাচনে উস্কানিমূলক বক্তব্য বা আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এটা নিশ্চিত করতে হবে।’
অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী বলেন, ‘আশা করবো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো প্রক্রিয়ার জন্য কেউ চেষ্টা করবে না। আমাদের নতুন প্রজন্ম রাজনীতিবিমুখ হয়ে গেছে। এটা যখন হয়ে যায়, তখন রাষ্ট্র অরক্ষিত হয়ে যায়।’