‘এখানকার সব বাড়ি আমার এমএনপি ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ২৪৮ নম্বর রুম থেকে ভেসে আসছে। যেটা ইচ্ছা সেটা নিয়ে যাও। আমি রুহুল আমিন হাওলাদার বলছি।’ পাশের ২৪৯ নম্বর রুম থেকে চিৎকার করে কামাল হোসেন
বলছেন ‘আমি সুস্থ। আমাকে বের করে নিয়ে যাও। বাড়িতে যাবো। ছেলেকে কোলে নেবো।’ এই হলো আগারগাঁও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অবস্থা। এখানে আছে ঈমানদার পাগল, হাঁটা পাগল, গল্পবাজ পাগলসহ ডিজিটাল পাগলও। ওয়ার্ডগুলো ঘুরে দেখা যায়, কোনো পাগল দিন-রাত নামাজ পড়ছে। কেউ সারাদিন হাঁটছে। কেউ নিজে নিজে কথা বলছে অনর্গল। কেউ নতুন কাউকে দেখলেই কাছে ডেকে মোবাইল দিয়ে সেলফি তোলার বায়না ধরছে। ২৪৮ নম্বর রুমের পাগল রুহুল আমিন। নিজেকে পরিচয় দেন মন্ত্রী হিসেবে। ডাক্তার, নার্স বা নতুন মানুষ পেলে চিৎকার করে বলে আমাকে আটকে রাখার ক্ষমতা কারো নেই। আমাকে ছাইড়া দিতে হবে। এই রুহুল আমিনকে না ছাড়লে সবার খবর আছে। পরক্ষণেই বলে আলী আজগর আমাকে মারতে চায় কেন। কত ক্ষমতা তার। রুহুল আমিনের সঙ্গে থাকা তার স্ত্রী এ প্রতিবেদককে বলেন, ১০ বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়। নেশা করতো। নেশা বেশি খেয়ে প্রায়ই পাগলামী করতো। এর আগে বেশ কয়েকবার এই হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়েছে। গত জানুয়ারিতেও এক মাস ভর্তি ছিল। কিছুটা উন্নতি হলে চলে যাই। একবার পাগলামী করতে গিয়ে রাস্তায় গাড়ির নিচে পড়ে পা কাটা গেছে।
২৪৯ নম্বর রুমে গিয়ে দেখা যায়, মো. কামাল হোসেন চিৎকার করে বলছে আমি সুস্থ। আমাকে বের করো। বাড়িতে যেতে দাও। নতুন মানুষ কাছে পেয়ে শুনাতে থাকে তার চাকরি জীবনের গল্প। পাগল নয় ভালো মানুষ প্রমাণ দিতে জানায় আমাদের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন থানায়। নিজেদের ইলিশ মাছের ব্যবসা আছে। পরিবার নিয়ে তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার দাওয়াত দিতেও ভোলে না। পাশের বেডে বসে থাকা তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হাজী মো. আজহার আলী বলেন, এক মাস ধরে এখানে ভর্তি। আগে অনেক বেশি চিৎকার করতো। কাউকে ঘুমোতে দিতো না। এখন চিৎকার-চেঁচামেচি অনেকটা কম করে।
২৬২ নম্বর রুমে পাগল মো. রাজু মিয়া নিজেকে ঈমানদার হিসেবে পরিচয় দেন। পাশের বেডে রয়েছেন মিরাজুল ইসলাম। এদের দুইজনেরই কাজ সারাদিন নামাজ পড়া। এ প্রতিবেদককে দেখে এগিয়ে আসেন। বলেন, আমি আয়ারল্যান্ডের আরপি থানার ওসি। বলেন, আমার অনেক পরিচয় আছে। এখানে আমি নামাজ পড়াই। রাজুর মা জানান, গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া থানায়। ঢাকার কেরানীগঞ্জের এক টেইলার্সে কাজ করতো রাজু। দেড় মাস আগে পাগল হওয়ার পর থেকে গোসল করতে চায় না। শরীরে পানি ঢালতে চায় না। গোসল করতে নিলেও অন্যদের ভিজিয়ে দেয়।
২৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি নিজাম উদ্দিনের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার দবিগঞ্জ গ্রামে। চাকরি করতো ওয়ার্কশপে। হঠাৎ চাকরি হারানো মেনে নিতে পারেনি। চাকরি হারিয়ে সারাদিন বাড়ি বসে থাকতো। কারো সঙ্গে কথা বলতো না। এক পর্যায়ে খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দেয়। মা ফুলেসা বেগম মানবজমিনকে বলেন, চাকরি যাওয়ার পর থেকে কারো সঙ্গে কথা বলতো না। গত এক মাস থেকে কোনো খাবার দিলেও তা খায় না। জোর করে কিছু খাওয়ালে বমি করে বের করে দেয়। তবে কোনো ধরনের উৎপাত করে না। হাসপাতালে আসার পর হাঁটা-চলা করে। এখন কিছু ওষুধ ও ফল ফলাদি খাওয়ানো যায়।
ওয়ার্ডের সবাই ডিজিটাল পাগল বলে চেনেন ওয়াসিম ইসলামকে। চলাফেরা ভালো মানুষের মতো। সব সময় স্মার্ট হয়ে চলাফেরা, নার্সদের ফাইলপত্র এগিয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের কাজও করে দেয় ওয়াসিম। নতুন মানুষ দেখলে শুরু করে প্রেমের গল্প। বিদায় নেয়ার সময় মোবাইলফোন দিয়ে সেলফি তুলতেও ভুল করে না। এই প্রতিবেদকের কাছে ঝর্ণা নামের এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের গল্প বলতে থাকেন। ঝর্ণাকে ভালোবাসলেও তার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। এর পর এলাকার এক মাস্তানের সঙ্গে মারামারিতে মাথায় আঘাত পেয়ে পাগল হয়ে যায় বলে জানায় ওয়াসিম। ওয়াসিমের মা গোল আক্তার বলেন, বাড়ি নরসিংদী জেলার পলাশ থানার তালতলা গ্রামে। দেড় মাস ধরে সমস্যা হলেও ২৩ দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে ২ বছর আগে সমস্যা হলে মাসখানেক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে যায় সে সময়। প্রথমে অসুস্থ হলে হাতে-পায়ে শিকল দিতে হতো। এখন তেমন উৎপাত করে না। তবে সারাদিন কথা বলে, মোটেও ঘুমোতে চায় না।
হাসপাতালে ভর্তি পাগলদের স্বজনরা জানান, ডাক্তার নিয়মিত আসেন না। আসলেও ঠিকমতো রাউন্ড দেন না। স্বজনদের দাবি ৩ দিন পর পর ডাক্তার আসেন। নার্সও অনেক কম। তবে এমএনপি ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বরত নার্স হালিমা খাতুন বলেন, তিনজন রোগীর জন্য ১ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও আমাদের এখানে ৩৩ জনের জন্য একজন নার্স আছে। এতোগুলো রোগীকে একনাগাড়ে ৮ ঘণ্টা দেখাশুনা করতে হয় একজন নার্সকে। সপ্তাহের রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার ডাক্তাররা রাউন্ড দেন। সকালে এসে রোগীদের দেখে চলে যান। তিনি বলেন, একেকজন পাগলের একেক ধরনের সমস্যা। সমস্যার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ওষুধ লেখেন ডাক্তার। অধিকাংশ ওষুধ হাসপাতাল থেকে পাওয়া যায়। দুই একটা ওষুধ না পাওয়া গেলে বাইরে থেকে কিনতে হয় রোগীর স্বজনকে।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |