মান নিয়ে প্রশ্ন মো. মাসুদ। ১৫ বছরের এই কিশোর প্রাইমারিও পেরোতে পারেননি। কিন্তু চোখের দেখায় নিমিষেই তৈরি করছেন বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ। যে কোনো মেশিনারি যন্ত্রাংশ একবার দেখলেই হুবহু বানিয়ে দিতে পারে তা। শুধু মাসুদই নয়। তার মতো বহু কারিগর নিয়মিত কাজ করছেন জিঞ্জিরায়। বিদেশ থেকে আমদানি করা কোনো মেশিনও হুবহু বানিয়ে দিচ্ছেন নিমিষেই। এমনকি গাড়ি কিংবা বিশ্বখ্যাত অ্যান্ড্রয়েড বা আইফোনের নকলও তৈরি করছেন এখানকার কারিগররা। সম্প্রতি সরজমিন জিঞ্জিরার তাওয়াপট্টি, আগানগর, বাঁশপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এলাকার বাসাবাড়িতে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কারখানা। যেখানে হাঁড়ি-পাতিল, ফ্লাস্ক, ওয়াটার হিটার, শ্যাম্পো, সাবান, আফটার শেভলোশন, ত্বকে ব্যবহারের নানারকম ক্রিমসহ বিদেশি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের হুবহু পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। নিম্নমানের জিনিসপত্র তৈরি করে দামি ব্রান্ডের স্টিকার ও হলগ্রাম লাগিয়ে চালান দেয়া হচ্ছে কালোবাজারে। এতে জিঞ্জিরায় তৈরি পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমাদের কারিগররা সবই তৈরি করতে পারেন। কিন্তু আমাদের বৈধতা নেই। নেই কোনো উন্নত প্রশিক্ষণও। দেখে দেখে সব শিখেছে এখানকার কারিগররা। অনুকরণই তাদের মূল ভরসা। মোজাফফর আলী নামে এক কারখানা মালিক বলেন, ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ী আমাদের কাছ থেকে কাজ করান। তারা যে পণ্যের অর্ডার দেন আমরা সেটা  তৈরি করে দেই। তারা যে মানের কাঁচামাল দেয় জিনিসও সেই মানের তৈরি হয়। ফেরিঘাট এলাকায়
গিয়ে দেখা যায় একটি কারখানায় সিলভারের পাতিল তৈরির কাজ চলছে। পাশেই তৈরি পাতিলে একটি নামি ব্রান্ডের স্টিকার লাগানো হচ্ছে। জানতে চাইলে কারখানার মালিক বলেন, পুরান ঢাকার দুজন মহাজন কাজ দিয়েছেন। তারা মাল দিয়ে গেছেন। আবার তৈরি হওয়ার পর তাতে লাগানোর জন্য স্টিকারও দিয়ে গেছেন। এরকম যে যে মালের অর্ডার দেন আমরা তা তৈরি করি।
রুনা স্টিল হাউসের ম্যানেজার আনিসুর রহমান বলেন, জিঞ্জিরায় অনেক ভারি মেশিনও তৈরি হয়। সাধারণত একটা প্রেসার মেশিন চীন থেকে কিনতে সাত থেকে আট লাখ টাকা লাগলেও এখানে তিন লাখ টাকায় বানিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু ৭ লাখ টাকার মেশিন অরজিনাল। আর এখানে তৈরিটা তো দুই নম্বর। ব্যবহারে কম দিন টিকলেও ভালোই চলে। কোনো সমস্যা হয় না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, জিঞ্জিরার হালকা প্রকৌশল শিল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসতে পারে। এখানে উৎপাদিত অনেক পণ্যই দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা তো দূরে থাক, উল্টো ‘নকলবাজ’ হিসেবে দুর্নামের সিল মারা হয় এখানকার কারিগরদের কপালে। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি (বাইশিমাস) সূত্রে জানা যায়, জিঞ্জিরা থেকে সরকারের রাজস্ব আসে আড়াইশ কোটি টাকারও বেশি। জিঞ্জিরার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ৬ লক্ষাধিক কর্মীসহ পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ৬০ লাখ মানুষের ভাগ্য। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে রাজধানীঘেঁষা এই জিঞ্জিরায় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় দুই হাজার কারখানা। অক্ষরজ্ঞানহীন বা স্বল্পশিক্ষিত কারিগররাই এখানের কারিগর। এমন কোনো যন্ত্র নেই যা এখানে তৈরি হয় না। পৃথিবীর যে কোনো পণ্য বা যন্ত্রাংশ একবার দেখলেই তারা হুবহু বানিয়ে দিতে পারেন। আর এই সুযোগে একশ্রেণির ব্যবসায়ীও দামি ব্র্যান্ডের পণ্য নকল  করে বাজারজাত করে লুটে নেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
পাটোয়ারি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক মাসুম পাটোয়ারি বলেন, জাপান, চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো শিল্পোন্নত সব দেশই শুরুতে হালকা প্রকৌশল খাতে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। অথচ বাংলাদেশে সরকারিভাবে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং মাঝে মাঝে থানা পুলিশ এসে নকলের অভিযোগে হয়রানি করে। তিনি বলেন, এতো অবজ্ঞার পরও জিঞ্জিরার উন্নতি থেমে নেই। এখানকার অনেক ব্যবসায়ী এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশি যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানি করছেন।
আব্বাস আলী নামের এক কারখানা মালিক বলেন, নিজেদের নামে কোনো পণ্য বানালে পাবলিক কেউ কিনবে না। তাই ঢাকার ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দামি কোম্পানির নামে মালপত্র বানায়। সালাম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক আবদুস সালাম বলেন, জিঞ্জিরায় তৈরি পণ্যের চাহিদা ও কদর ক্রমেই বাড়ছে। আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি অর্ডার আসে। তবে আমাদের পর্যাপ্ত টাকা থাকলে বা সরকারি সুযোগ সুবিধা পেলে নকল না বানিয়ে নিজেরাই ভালো মানের জিনিসপত্র তৈরি করতে পারতাম।
যোগাযোগ করা হলে জিঞ্জিরার তাওয়াপট্টি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতির সভাপতি আকতার জিলানী খোকন মানবজমিনকে বলেন, অবহেলিত এই শিল্পের দিকে সরকারের নজর দেয়া জরুরি। আমাদের কারিগররা কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই দেখতে দেখতে সবকিছু তৈরি করা শিখে গেছে। সরকার থেকে কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে আরো দক্ষ হয়ে উঠবেন। তিনি বলেন, আমরা এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করার সক্ষমতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমাদের মূলধনের সমস্যা আছে। ব্যাংক লোন পাই না। সরকারি সহযোগিতাও পাই না। এমনকি লৌহজাত এসব শিল্পের জন্য কোনো বায়িং হাউস গড়ে ওঠেনি। কিভাবে পণ্য রপ্তানি করতে হয়, সেই কৌশল আমাদের জানা নেই। এমনকি বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের দক্ষতাও আমাদের নেই। যদি সরকার জিঞ্জিরাকে গুরুত্ব দেয় এবং এই শিল্পের জন্য বায়িং হাউস গড়ে ওঠে তাহলে আমরা এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে, যেমন ভুটান, মালদ্বীপ, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে আমাদের পণ্য রপ্তানি করতে পারবো।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031