নগরীর খুলশী থানার লালখান বাজার এলাকায় অবস্থিত মতিঝর্ণা পাহাড় ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়। পাহাড় দুটির মালিকানায় আছে সরকারের তিনটি সংস্থা। সংস্থাগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং চট্টগ্রাম ওয়াসা। ২০১১ সালের ১ জুলাই বাটালি হিলের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জন এবং ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট মতিঝর্ণায় পাহাড় ধসে মারা যান ১১ জন।

২০১৪ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের পাহাড় ব্যবস্থাপনা উপকমিটি এ দুটি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী ৩২০টি পরিবারের একটি তালিকা তৈরি করে। বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে। সর্বশেষ গত ৮ মে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৬তম সভায় উত্থাপিত ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকায়ও রয়েছে পাহাড় দুটির নাম। অভিযোগ আছে, ঝুঁকিতে থাকলেও পাহাড়গুলোর মালিক সরকারি সংস্থা তিনটির উদ্যোগে এখানে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়নি। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসনের পক্ষে পরিচালিত অভিযানেও সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ আছে। শুধু মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল নয়। নগরীতে বাংলাদেশ রেলওয়েসহ সরকারের ৬টি সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড় রয়েছে। অবৈধভাবে দখলে রেখে সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র এসব পাহাড় থেকে ভাড়ার নামে প্রতি মাসে আয় করছে অর্ধ কোটি টাকার ওপর। এসব পাহাড়ের তত্ত্বাবধানকারী সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি ৬টি সংস্থাকে নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা পাহাড়গুলো থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। গত ২৪ মে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবদুল জলিল স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাবেন এবং উচ্ছেদ কার্যক্রমে ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসন সহায়তা করবে।’ যে ৬টি সংস্থাকে চিঠি দেয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।

এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন পাহাড়গুলো হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ের সিআরবি পাহাড়, টাইগারপাস পাহাড় ও রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল সংলগ্ন পাহাড়। জেলা প্রশাসনের মালিকাধীন পাহাড় হচ্ছে ডিসি হিল, লালখান বাজার চাঁনমারি রোড সংলগ্ন জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের মালিকানাধীন রাস্তার পাশে বাটালি হিলের পাহাড়, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশেনের মালিকানাধীন বাটালি হিল, টাইগারপাসের মোড়ে ইন্ট্রাকো সিএনজির পেছনের পাহাড়, লেকসিটি আবাসিক এলাকার পাহাড় ও ভিআইপি হিল, বাটালি হিলের সিটি কর্পোরেশনের টাওয়ারসংলগ্ন পশ্চিম পাশের রাস্তার বিপরীত দিকে বসত এলাকা রয়েছে। এর মধ্যে ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড়ের দিকে ফুলের দোকানসমূহের অংশটি ঝুঁকিপূর্ণ।

এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব আবদুল জলিল বলেন, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বশেষ সভায় উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। তবে পাহাড়গুলোর যারা মূল মালিক তাদের পক্ষেও অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে আমরা তাদেরকে চিঠিও দিয়েছি।

গত ৮ মে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৬তম সভা। ওই সভায় সদর সার্কেলের সহকারী কমিশনার আছিয়া খাতুন বলেছিলেন, লালখান বাজারে রেলের মালিকানাধীন পাহাড় আছে। শুধু আমরা অভিযান করলে হবে না, পাহাড়ের মালিকরাও করলে কাজে সাফল্য আসবে। তিনি গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার পর এ পর্যন্ত আমরা ৫ বার অভিযান চালিয়েছি। এতে ৩শ পরিবারকে সরিয়ে দিয়েছি এবং তাদের বাসার গ্যাসবিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি।

নিজেদের মালিকানাধীন পাহাড়গুলো থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের পাহাড়ে কোনো বসবাসকারী নেই। নিচে আছে। ওদের তো আমরা উচ্ছেদ করতে পারব না। পানির সংযোগও আমরা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি।

এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশ ঘুরে এবং এখানে বসবাসকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এসব এলাকায় বসবাসকারীদের বেশিরভাগই নিম্নআয়ের লোকজন। কেউ রিকশা চালান, কেউবা দিনমজুর। কেউ আবার ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। তবে এদের পেছনে রয়েছে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী প্রভাবশালীরা। তারা এসব পাহাড় অবৈধ দখলে নিয়ে গড়ে তুলেছেন বস্তি এলাকা। আদায় করেন মাসিক ভাড়া।

অপেক্ষাকৃত কম দামে বাসা ভাড়া পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে বাস করেন নিম্নআয়ের ওইসব লোকজন। পাহাড়গুলোর মূল মালিক সরকারি সংস্থাগুলো অবৈধ দখলদারদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা না নেয়ায় দখলদারমুক্ত করা যাচ্ছে না পাহাড়গুলোকে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম শহরে গত ১৮ বছরে পাহাড় ধসে ১৯৬ জন প্রাণ হারান। শহরে প্রথম পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ১৯৯৯ সালের ১৩ আগস্ট। ওইদিন সিআরবি পাহাড়ের একাংশের সীমানা প্রাচীরসহ পাহাড় ধসে মারা যান ১০ জন। পরের বছর ২০০০ সালের ২৪ জুন চবি ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকাসহ নগরীতে পাহাড় ধসে মারা যান ১৩ জন। চট্টগ্রামে সর্বশেষ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। ওইদিন নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার জালালাবাদ মাঝের ঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান একই পরিবারের দুজন। ভোর সাতটার দিকে সংঘটিত ওই পাহাড় ধসে নিহতরা ছিলেন মামেয়ে। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই ঈদুল ফিতরের রাতে আধ ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক দুটি স্থানে পাহাড় ও দেয়াল ধসে ৫ শিশুসহ প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬ জন। এর মধ্যে রাত দুটার দিকে বায়েজিদ থানার আমিন কলোনির শাহাজাহান মিস্ত্রির ঘরে পাহাড় ধসে তিন ভাইবোন এবং এর আগে রাত দেড়টার দিকে লালখান বাজারের পোড়া কলোনি এলাকায় দেয়াল ধসে মামেয়েসহ মারা যান ৩ জন।

২০১৪ সালে পাহাড় ধসে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। তবে টানা বর্ষণের ফলে ২০ জুন পৃথক তিনটি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চেরাগী পাহাড় রাজাপুকুর লেনের দয়াময়ী কলোনিতে পাহাড় ধসে চারজন আহত হন। এছাড়া প্রবর্তক মোড় এবং টাইগারপাস এলাকায় পাহাড় ধসে কেউ হতাহত না হলেও আশপাশের লোকজনের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে।

২০১৩ সালের ২৮ জুলাই পাহাড় ভোর সোয়া ৫টার দিকে লালখান বাজারের টাংকির পাহাড়ে ধসের ঘটনায় মামেয়ের মৃত্যু হয়েছিল। একই বছরের ৯ জানুয়ারি খুলশী থানার ইস্পাহানি গোলপাহাড় সি গেট এলাকায় সাহারা খাতুন নামে এক গৃহবধূ মারা যান।

২০১২ সালের ২৬ জুন নগরীর চার স্থানে পাহাড় ধসে প্রাণ হারান ১৮ জন। এর মধ্যে খুলশী আকবর শাহ হাউজিং এলাকার ইয়াছিন কলোনিতে ৭ জন, বিশ্ব কলোনিতে একই পরিবারের ৫ জন এবং উত্তর পাহাড়তলী জালালাবাদ আঁন্দারমানিকে একই পরিবারের ২ জন এবং মক্কীঘোনায় ৪ জন মারা যান।

২০১১ সালের ১ জুলাই বাটালি হিলের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে পড়লে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন ১৭ জন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট মতিঝর্ণায় পাহাড় ধসে মারা যান ১১ জন। ২০০৭ সালের ১১ জুন নগরীর সাতটি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনায় প্রাণ হারান ১২৭ জন।

ঝুঁকিপূর্ণ ৩০ পাহাড়

গত ৮ মে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি পাহাড়ের তালিকা উপস্থাপন করা হয়। পাহাড়গুলো হচ্ছে সিআরবি পাহাড়ের পাদদেশ, টাইগারপাসলালখান বাজার রোড সংলগ্ন পাহাড়, টাইগারপাস মোড়ের দক্ষিণপশ্চিম কোণ, মোজাফ্‌?ফর নগর পাহাড়, কাট্টলী থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত পাহাড়, সলিমপুর বাস্তুহারা পাহাড়, প্রবর্তক পাহাড়, গোলপাহাড়, ইস্পাহানী পাহাড়, বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়, জয়পাহাড়, চট্টেশ্বরী হিল, মতি ঝর্ণা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল সংলগ্ন পাহাড়, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকার পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, গরিবউল্লাহ শাহ মাজারের পাশের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড়ের দিকের ফুলের দোকানসমূহের অংশ, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশনের পাহাড়, এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন পাহাড়, কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনির পাহাড়, মিয়ার পাহাড়, লালখান বাজার চাঁনমারি রোড সংলগ্ন জামেয়াতুল উলুম ইসলামি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পাহাড়, ফরেস্ট রিচার্চ ইনস্টিটিউট একাডেমির উত্তর পাশের মীর মোহাম্মদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়, ইস্পাহানী পাহাড় সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের হারুন খানের মালিকানাধীন পাহাড়ের পশ্চিমাংশ, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, লেক সিটি আবাসিক এলাকার পাহাড় ও সিডিএ অ্যাভিনিউ রোডের পাশে অবস্থিত ব্লোসম গার্ডেন সংলগ্ন পাহাড়।

– See more at: http://www.dainikazadi.org/details2.php?news_id=193&table=june2017&date=2017-06-03&page_id=1&view=0&instant_status=0#sthash.rlKqpqDM.dpuf

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031