রাজশাহী বিএনপি জেলা ও মহানগরের নতুন কমিটি করা নিয়ে শুরু হওয়া দ্বন্দ্বে বির্পযন্ত হয়ে পড়েছে। জেলার সঙ্গে জেলা, মহানগরের সঙ্গে মহানগর, আবার মহানগরের সঙ্গে জেলা এই দ্বন্দ্ব নিয়েই রাজশাহী বিএনপির নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি গঠিত দুই কমিটিতেই বাদ পড়েছেন পুরনোরা।
বাদ পড়া নেতাদের সমর্থকরা অভিযোগ করছেন, নিস্ক্রিয়দের দিয়ে গঠন হয়েছে কমিটি। এ জন্য তারা বিদ্রোহ করছেন। আর এই বিদ্রোহের ফলেই প্রতিনিয়ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে দলীয় কর্মসূচিতে।
দীর্ঘ সাত বছর পর গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলা ও মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। দুই কমিটির শীর্ষ চার পদের তিনটিতেই পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুনদের নেতৃত্ব দেওয়া হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় কোন্দল। এর জের ধরে দলের মহানগর কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই নয়, মহানগরের কমিটি বাতিলের দাবিতে বিএনপি রক্ষা কমিটিও করা হয়েছিল। পরে অবশ্য কার্যালয়ের তালা খুলে দেওয়া হয়।
কিন্তু গত সোম ও মঙ্গলবার জেলা ও মহানগর বিএনপির কর্মী সম্মেলনে নেতাকর্মীদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের উপস্থিতিতে দুই দিনই সম্মেলনস্থলে বিক্ষোভ শুরু করেন দুই কমিটি থেকে বাদ পড়া নেতাদের সমর্থকরা। ফলে নিজ দলের নেতাদের মধ্যেই দফায় দফায় ঘটে সংঘর্ষ।
শুধু তাই নয়, সম্মেলন শেষে বিমানবন্দরে কেন্দ্রীয় নেতাদের বিদায় দিতে গিয়েও ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা। মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলনের হাতে লাঞ্ছিত হন জেলার সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টু।
নেতাকর্মীরা বলছেন, আগের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দলকে সংগঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা রাজশাহী এলেও এতে কোনো লাভ হলো না, বরং ওই কর্মী সম্মেলনের মধ্যে দিয়েই দলের নেতাকর্মীদের বিদ্রোহ প্রকাশ্যে এলো।
এদিকে দলের শীর্ষ নেতাদের এমন দ্বন্দ্বের নেতিবাচক প্রভাব উপজেলা পর্যায়েও পড়তে শুরু করেছে। নিজ নিজ গ্রুপের লবির নেতাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর বিএনপির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন আগের কমিটিতে একই পদে ছিলেন। তবে বর্তমান কমিটিতে সভাপতি করা হয়েছে সিটি মেয়র মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে। আগের কমিটিতে সভাপতি ছিলেন সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু। মিলন এখনও মিনুর অনুগত নেতা হিসেবে পরিচিত। তাই কমিটি ঘোষণার পরই বুলবুলকে বাদ দিয়ে মিনুকে আবার সভাপতি করার দাবি ওঠে। শুরু হয় আন্দোলন।
অন্যদিকে নাদিম মোস্তফাকে জেলা বিএনপির সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে সহসভাপতি তোফাজ্জাল হোসেন তপুকে নতুন কমিটির সভাপতি এবং কামরুল মনিরকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
দলীয় নেতারা বলছেন, নাদিম মোস্তফা ও মিজানুর রহমান মিনুর ইশারায় তাদের সমর্থকরা জেলা ও মহানগর বিএনপির কর্মী সম্মেলনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তা পণ্ড করার চেষ্টা করেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন মহানগর যুবদলের নতুন কমিটির পদবঞ্চিত নেতারা। সংঘর্ষের চলাকালে মিনুর আচারণেও এমনটা দেখা গেছে।
কারণ মহানগরের সম্মেলনের দিন সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করলেও ওই সময় চুপচাপ মঞ্চে বসে ছিলেন মিনু।
অন্যদিকে জেলার সম্মেলনের দিন সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফার সমর্থক হিসেবে পরিচিত সহ-সভাপতি দেলোয়ার হোসেন ও যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ মহসিন আলীর নেতৃত্বে একদল কর্মী মিছিল নিয়ে গিয়ে সমাবেশস্থলে প্রবেশ করে ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় ছিঁড়ে ফেলা হয় মঞ্চের ব্যানার, ভাঙচুর করা হয় মঞ্চ ও সামনের চেয়ার। কেউ কেউ জুতা খুলেও ছুঁড়ে মারেন মঞ্চের দিকে।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে মিলন রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে প্রার্থী হতে চান মহানগরের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন। মহানগরের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান মিনু অনেক আগেই এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কিন্তু জেলার আসনে কে প্রার্থী হবেন, এখন নতুন করে তার সিদ্ধান্ত দিতে চায় জেলা কমিটি। এ কারণেই বিমানবন্দরে জেলার সম্পাদককে লাঞ্ছিত করেন মহানগরের সম্পাদক।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জেলার সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টু বিষয়টি স্বীকার করেন। মিনুকে ইঙ্গিত করে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, এতদিন বন-জঙ্গলের একমাত্র ‘টাইগার’ ছিলেন একজন। তিনি মহানগর কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন। তারপরেও তিনি মহানগরের পাশাপাশি জেলাতে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করছেন। ফিরে পেতে চাইছেন পুরনো আধিপত্য।’
মন্টু বলেন, ‘শুধু মহানগরই নয়, জেলার সাবেক কমিটির নেতারাও নতুন কমিটিকে মেনে নিতে পারেননি। বিশেষ করে সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফা কোনোভাবেই নতুন কমিটিকে মেনে নিচ্ছেন না। জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে নাদিম মোস্তফার নির্বাচনী এলাকা থেকে কিছু নেতার নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছিল জেলা বিএনপি। নাদিম মোস্তফা কেন্দ্রে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি থেকে সেসব নাম বাদ দিয়েছেন।’
জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে নাদিম মোস্তফা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জেলা কমিটি আমার মতামত ছাড়াই নেতাদের নাম পাঠিয়েছিল। দলের চেয়ারপারসন সেগুলো বাদ দিয়েছেন। এখানে আমি কিছুই করিনি।’
জেলা কমিটির সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টিও নাদিম মোস্তফা অস্বীকার করেন। বলেন, ‘ম্যাডাম খালেদা জিয়া যে কমিটি দিয়েছেন, সে কমিটিই মেনে নিয়েছি।’
মহানগর কমিটি নিয়ে বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে জানতে চাইলে সভাপতি ও সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ‘নেতৃত্ব আকড়ে ধরে রাখার জন্য একটি পক্ষ গভীর ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু এটা করা ঠিক না। নতুনদের হাতে নেতৃত্ব না দিলে দলে নেতা তৈরি হবে না। এতে দলেরই ক্ষতি হবে। দলের চেয়ারপার্সন কমিটি করে দিয়েছেন, সেটাই চূড়ান্ত। এ নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।’
আর সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, ‘কমিটিতে পদবঞ্চিতরাই বিশৃঙ্খলা করছেন। কিন্তু এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ জেলার সম্পাদককে লাঞ্ছিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে মিলন বলেন, ‘কয়েকদিন ধরেই তো ঝামেলা চলছে। আমি সবাইকে শান্ত করছি। মন্টুর সঙ্গে বিমানবন্দরে কথা কাটাকাটি হয়েছে। লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেনি।’
বিএনপির জেলা-মহানগরের এমন প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে চাইলে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু ঢাকাটাইমসকে বলেন, বিএনপি একটা বড় দল। এমন ঝামেলা হবেই। ছোটরা নেতৃত্ব পেতে চায়। এ জন্য সমস্যা হচ্ছে। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে বিক্ষুব্ধদের শান্ত করা হবে।
তার নিজের কারও সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলেও দাবি করেন মিনু।