জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে ৮০ বছরের বৃদ্ধা মারজাহান বেওয়ার ছেলে, ছেলের বৌ ও তিন নাতি-নাতনি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বেনীপুরে। কিন্তু তাদের কারোরই লাশ নেবেন না তিনি।
মারজাহান বিবি বলছেন, মানুষ হিসেবে সবার জন্যই মন কাঁদছে। কিন্তু কোনো দেশবিরোধী সন্তানের লাশ গ্রহণ করবেন না তিনি। মারজাহান বিবি মনে করেন, কেউ খারাপ কাজ করলে তার শাস্তি হয়, তার ছেলেসহ পরিবারের সদস্যরা তেমন শাস্তিই পেয়েছে।
মারজাহান বিবি জানান, তিনি লাশ নেবেন কী না সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার কাছে এখনও কিছু জানতে চায়নি। তবে জানতে চাইলে তিনি সাফ জানিয়ে দেবেন, কারো লাশ নেবেন না তিনি।
বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকে বেনীপুর গ্রামের সাজ্জাদ আলীর বাড়িটি ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এরপর ভেতরে থাকা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু জঙ্গিরা তাতে সাড়া দেয়নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তখন বাড়িতে পানি স্প্রে করা শুরু করে।
এ সময় জঙ্গিরা বাড়ি থেকে বের হয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এক নারী জঙ্গি প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আবদুল মতিনকে। এ সময় দুই পুলিশ সদস্যও আহত হন।
এ ঘটনার পর পুলিশি অভিযানে বাড়ির মালিক সাজ্জাদ হোসেন (৫০), তার স্ত্রী বেলী বেগম (৪৫), তাদের ছেলে সোয়াইদ (২৫), আল-আমিন (২০) ও মেয়ে কারিমা খাতুন (১৭) নিহত হয়। পুলিশ বলছে, তারা আত্মহুতি দিয়েছে। আর অভিযানের পর সাজ্জাদের মেয়ে সুমাইয়া পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় সুমাইয়ার দুই শিশু সন্তানকেও।
বেনীপুরের সাজ্জাদ আলীর বাড়ি থেকে মাত্র প্রায় ৫০০ মিটার দূরে তার ছোট ভাই মুক্তার আলীর বাড়ি। এ বাড়িতেই ছেলের সংসারে থাকেন সাজ্জাদের মা মারজাহান বিবি। বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই বাড়িতে গিয়েই কথা হয় তার সঙ্গে।
মারজাহান বিবি বলেন, বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে মাছমারা গ্রামের লুৎফর রহমান নামে এক ব্যক্তির মেয়ের সঙ্গে সাজ্জাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর থেকে সাজ্জাদ তার শ্বশুর বাড়ির পাশেই একটি বাড়ি করে থাকত। মাস চারেক আগে শ্বশুরের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব হয়। এ দ্বন্দ্বের পর সাজ্জাদ পরিবার নিয়ে গোদাগাড়ী পৌরসভার মহিষালবাড়ি মহল্লায় কিছুদিন ভাড়া থাকে।
ছেলেকে ভাড়া বাড়িতে থাকতে দেখে মারজাহান বিবি বেনীপুরে মাঠের ভেতর তাকে পাঁচ কাঠা জমি দেন বাড়ি করতে। মাস দুয়েক আগে বাড়িটির নির্মাণ শেষ হয়। এরপর সাজ্জাদ পরিবার নিয়ে ওই বাড়িতে ওঠেন। দুই মাসে মাত্র দুই বার ছেলের বাসায় গেছেন মারজাহান বিবি। কিন্তু সেখানে অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি বলে দাবি করেন তিনি।
মারজাহান বিবি বলেন, সাজ্জাদ আলীর স্ত্রী ও মেয়েরা খুব পর্দাশীল ছিল। তাই মুক্তারের বাড়িও তারা খুব একটা যেত না। বছরে দু’একবার যেত। ছেলের পরিবারটির সঙ্গে তার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। এ জন্য তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন তিনি।
মুক্তার আলীর স্ত্রী শামিমা খাতুন (৩৫) বলেন, লোকমুখে তারা শুনেছেন- বেলী বেগম অস্ত্র হাতে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ জন্য তিনি বিশ্বাস করেছেন- পরিবারটি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল। তা না হলে তারা বিশ্বাসই করতে পারতেন না। এখন যেহেতু তারা বিশ্বাস করেছেন, তাই তাদের কারোরই লাশ নেবেন না। তার স্বামী মুক্তার আলীও কারো লাশ নেবেন না বলে জানান তিনি।
এদিকে সকালের অভিযানে বাড়ির বাইরে পাঁচ জঙ্গি নিহত হলেও সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ বলছে, বাড়ির ভেতরে এখনও কোনো জঙ্গি অবস্থান করছে কী না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ জন্য বাড়ির ভেতরেও ঢোকা হয়নি। ঘটনাস্থলে আসছে সোয়াত টিম ও বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল। তারা আসার পরই বাড়ির ভেতরে অভিযান চালানো হবে।
বিকেল থেকে ওই এলাকায় সামান্য পরিমাণে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। বাড়ির বাইরে পড়ে কেটে নেওয়া ধানের জমিতে পড়ে আছে পাঁচ জঙ্গির লাশ। নিহত সাজ্জাদ আলী পেশায় একজন কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।