বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ব্যাটলিয়ন বা ইসিবি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার-ইনানী-টেকনাফ সদর সংযোগ সড়ক পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর তীর সংলগ্ন দীর্ঘ প্রায় ৮০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ বাস্তবায়ন করছে । বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, পাহাড় ও জনপথ ঘেরা মাইলফলক সৃষ্টিকারী মেরিন ড্রাইভ সড়ক আগামী ৬ মে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিবেন। ইতিপূর্বে ২০১০ সালের শেষ দিকে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার মধ্যে আন্তঃসংযোগ ফিডার সড়কটি নির্মাণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বা এলজিইডি।
সংগত কারণে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী উখিয়ার দুর্গম মনখালী গ্রামের জেলে আব্দুল হান্নানকে এখন সমুদ্রের জোয়ার ভাটার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয় না। উপকূলীয় এলাকার অসুস্থ লোকজন, গর্ভবর্তী মহিলা ও স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাগামী ছাত্র-ছাত্রীদের এখন আর গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে হয় না। এ এলাকার জেলেরা সাগর থেকে আহরিত মাছ নিয়ে এখন যে কোন সময় যে কোন ধরনের যানবাহনে করে নিকটবর্তী হাট বাজার, উপজেলা কিংবা জেলা সদর এমনকি দেশের যে কোন প্রান্তে বাজারজাত করতে পারছে। যেখানে কোন কাঁচা সড়ক পর্যন্ত ছিল না সেখানে বর্তমানে দুই দুইটি পাকা সংযোগ সড়ক, অসংখ্য ইট বিছানো রাস্তা। কক্সবাজারের কলাতলী থেকে উখিয়ার ইনানী-মনখালী হয়ে টেকনাফের শামলাপুর থেকে টেকনাফ সদর জপর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৮০ কিলোমিটারের দুইটি পাকা সড়ক। বিস্তৃর্ণ এলাকার মানুষগুলোর দুঃখ কষ্ট লাঘবের পাশাপাশি পাল্টে যাচ্ছে তাদের জীবনযাত্রা, পর্যটক সহ আর্থসামাজিক কাঠামো গত সার্বিক উন্নয়ন চিত্র।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উখিয়ার ইনানীতে সেনাবাহিনীর অবকাশ কেন্দ্র বে-ওয়াচ সংলগ্ন এলাকায় শনিবার দুপুর নাগাদ আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের দীর্ঘতম নব নির্মিত এ মেরিন ড্রাইভ রোডের উদ্বোধন করবেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ব্যাটলিয়ান বা ইসিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এ কে মেহেদি হাসান মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান, দীর্ঘ ২৬ বছরের পরিশ্রম আর মেধার সমম্বয়ে সেনাবাহিনীর ইসিবি দীর্ঘ এ সড়কটি নির্মাণ করতে পেরেছে। এটি নির্মাণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তাদের গর্বিত ৬ সেনা সদস্যকে হারাতে হয়েছে। পাহাড় ধসের ঘটনায় ৬ জন সেনাসদস্য প্রাণ হারান। এ দীর্ঘ সময় ধরে সেনা সদস্যদের প্রকৃতির সাথে নানা সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে জয়ী হতে হয়েছে। এসড়কটি আরো দৃষ্টিনন্দন, মনোমুগ্ধকর ও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে ইসিবির আরো ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে।
কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকৃতির প্রতিকূলতা সত্বেও দীর্ঘ পরিশ্রম আর মেধার সমম্বয় এবং ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের মধ্যে ইতিহাস সৃষ্টিকারী দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটার মেরিনার্স রোডটি নির্মাণ করেছে। এটি দিয়ে অনেক আগে থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে আগামী শনিবার প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গতা পাবে। সমুদ্রের নীল জলরাশির ঢেউ, পাহাড় ও প্রকৃতির সবুজ সমারোহ ইত্যাদি উপভোগে সারাদেশের লোকজন ও বিশ্বের ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের প্রতীক্ষা শেষ হতে চলেছে। প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে সাগরের সাথে। হিমছড়ি কলাতলীসহ অধিকাংশে সমুদ্রের জোয়ার ও বর্ষার প্রবল স্রোতে ব্যাপক ভাঙনের কবলে পড়া এ সড়ক সচল রাখতে চালাতে হয়েছে কারিগরি যুদ্ধ। একদিকে সমুদ্রের মত প্রকৃতির ধংসলীলা, অন্যদিকে পাহাড়ে পাদদেশে হওয়ায় বর্ষাকালে পাহাড় ধস সহ নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই সেনাবাহিনীকে এ কঠিন গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোর ৮০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ করেছে। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে এখন চলছে সৌন্দর্য বৃদ্ধির প্রলেপের কাজ।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কক্সবাজার সূত্রে জানা গেছে, ৪৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার-ইনানী-টেকনাফ মেরিনার্স সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। প্রকল্পের দায়িত্বশীল সূত্রমতে, ২০১৪-২০১৭ অর্থবছরের জুন নাগাদ কক্সবাজার থেকে ইনানী হয়ে টেকনাফের শীলখালী পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। তবে পর্যটনের সুবিধার্থে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় টেকনাফ সদর পর্যন্ত সংযুক্ত করতে সড়কের দৈর্ঘ্য আরো ৩২ কিলোমিটার বৃদ্ধি করা হয়। এতে ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়সহ বিভিন্ন কাজের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি পায় ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু সেনাবাহিনীর আন্তরিকতা, দক্ষতা, মেধা ও পরিশ্রমের ফলে নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় এক বছর আগে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
মেরিন ড্রাইভ সড়কটি পর্যটকদের কাছে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলতে সড়কের দু’পাশকে ঘিরে রয়েছে নানা আর্কষণীয় ও মনোমুগ্ধকর পরিকল্পনা। সড়কের দু’পাশ জুড়ে পর্যটকদের সুবিধার্থে থাকবে ওয়াকওয়ে, থাকবে শেড, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, চেঞ্জিং রুম। সূত্র মতে, ৮০ কিলোমিটারের নির্মিত মেরিন ড্রাইভ সড়কে রয়েছে ৩টি বড় আরসিসি সেতু, ৪২টি বক্স কালভার্ট, ৩ হাজার মিটার সসার ড্রেন, ৫০ হাজার মিটার সিসি ব্লক, জিও টেক্সটাইল ও সাগরের ঢেউ থেকে সড়ক রক্ষায় প্রয়োজন অনুসারে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজও।
উখিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ করে বাংলাদেশ মাইকফলক তৈরি করেছে। নান্দনিক এ সড়ক নির্মাণের ফলে কক্সবাজার-ইনানী হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটার জনপথ জুড়ে আর্থসামাজিক অবস্থা ও অবকাঠামো উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। ইতিমধ্যে ইনানীতে চালু হয়েছে বিশ্বমানের তারকা হোটেল ও স্যুইট রয়েল টিউলিপ কমপ্লেক্স। ইনানীতে স্বাস্থ্য বিভাগ নির্মাণ করেছে আধুনিক হাসপাতাল, গড়ে উঠেছে অনেক তারকা মানের আরো বাণিজ্যিক অবকাঠামো। ইনানীতে স্থাপিত হয়েছে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পাওয়ার সাব স্টেশন। এসবের ফলে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান ও ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটছে বলে তিনি জানান।