জন্ম থেকেই ছিল তার দুঃখভরা জীবন বিচার না পেয়ে মেয়েসহ আত্মহত্যায় প্রতিবাদ করে গেলেন যে হযরত আলী, । জন্মের পরপর বাবাকে হারানোর মধ্য দিয়ে সেই যে শুরু তার ‘অপয়া’ জীবন, তা পিছু লেগে ছিল জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে।
হযরত আলীর আজন্ম দুর্ভাগ্যের গল্প জানা গেল তার পৈতৃক বাড়ি গফরগাঁওয়ে গিয়ে। মৃত্যুর পরও দুর্ভাগা হযরত আলী, তার মৃত্যুসংবাদ ভাইয়েরা জানলেন দুই দিন পর।
নানা ঘাট ঘুরে ঘুরে গাজীপুরের শ্রীপুরে থিতু হওয়া হযরত আলীর পৈতৃক বাড়ি গফরগাঁও উপজেলার কালাইর পাড় গ্রামের কদমতলী পাড়ায়।
পৈতৃক এলাকায় গিয়ে পাওয়া যায় তার সহোদর আবুল কাশেম, দূরসম্পর্কের ভাই শামছুল হক, মইযুদ্দিন, আ. হাদী ও আবুল হোসেনকে। তারা হযরত আলীর মর্মান্তিক খবরটি জানতে পারেন দুই দিন পর। ওই এলাকায় পত্রপত্রিকার পাঠক খুব বেশি নেই। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে খবরটি প্রচারিত হলেও এলাকার লোকজন ও আত্মীয়স্বজন বিষয়টি প্রথম বুঝতে পারেনি।
হযরত আলীর ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে কথা হয় তার সহোদর ও চাচাতো ভাইদের সঙ্গে। তাতে বেরিয়ে আসে চিরদরিদ্র ও দুঃখী হযরত আলীর জীবনের ছবি।
তার জন্ম প্রায় ৬০ বছর আগে। জন্মের মাত্র কয়েক দিন পর মারা যান বাবা রেজুদ্দিন। মা হাসিন বানু তিন শিশুপুত্র আবুল হাসেন, আবুল কাশেম ও হযরত আলীকে নিয়ে আশ্রয় নেন বাবার বাড়ি গফরগাঁও উপজেলার মুক্তাপাড়া গ্রামে ভাইদের বাড়িতে। সেখানে হাসিন বানু বাবার সম্পত্তি থেকে ৭০ শতক ফসলি জমি পেলে শিশুপুত্রদের নিয়ে কোনোমতে দিন গুজরান করছিলেন। কিছুদিন পর মা হাসিন বানু মারা গেলে এলাকার প্রভাবশালীরা ওই ৭০ শতক ফসলি জমি দখল করে নেয়।
পুরো নিঃস্ব হয়ে হাসিন বানুর তিন ছেলে আবার এসে আশ্রয় নেয় পৈতৃক হারানো ভিটা- চাচাতো ভাই সাদত আলীর বাড়িতে। চাচাতো ভাই সাদত আলী মারা গেলে তারা সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় নিজ নিজ শ্বশুরবাড়ি এলাকায় আশ্রয় নেন। এরই মধ্যে হযরত আলীর প্রথম স্ত্রী চরম দারিদ্র্য সইতে না পেরে চলে যান। রেখে যান একটি কন্যাসন্তান।
পরে হযরত আলী দ্বিতীয় বিয়ে করেন শ্রীপুর উপজেলার কর্নপুর গ্রামের হালিমা বেগমকে। দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়িই ছিল তার সর্বশেষ আশ্রয়। এরই মধ্যে বড় হয় তার প্রথম ঘরের কন্যাসন্তানটি। তাকে বিয়েও দেন, কিন্তু বিয়ের পর থেকেই শুরু হয় স্বামীর নির্যাতন। সন্তানের ওপর নির্যাতনের বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো বিচার পাননি হযরত আলী। দিনের পর দিন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মেয়ে।
নিজের কোনো জমি না থাকায় মেয়েকে কবর দিতে হয় গফরগাঁও উপজেলার হাটুরিয়া গ্রামের রিকশাচালক মোসলেম কাজির পারিবারিক কবরস্থানে।
এদিকে দ্বিতীয় স্ত্রী হালিমা বেগমের কোনো সন্তান না থাকায় এক দিনের শিশু আয়েশা আক্তারকে দত্তক নেন তারা। তাকে নিজ সন্তান হিসেবে লালন-পালন করেন হযরত আলী ও হালিমা দম্পতি। এই সময়ে স্ত্রী হালিমা ও পালিত সন্তান ছিল তার জীবনসংগ্রামের একমাত্র সুখের আশ্রয়। কিন্তু বিধাতা যেন আড়ালে হাসছিলেন। সেখানেও নেমে আসে সমাজের কিছু মানুষের নির্যাতনের থাবা। দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসা তাদের বসতভিটাটি দখল করতে চক্রটি নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে হযরত আলীকে। সাত বছরের কন্যাসন্তানকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। একমাত্র সম্বল গরুটি বাড়ির পাশ থেকে ধরে নিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা। কিন্তু এর কোনোটির বিচার পাননি জীবনের পদে পদে দুর্ভাগ্যের শিকার হযরত আলী।
জন্মের পর চোখ মেলেই দেখলেন বাবার মৃত্যু। এরপর নানার বাড়িতে আশ্রয়, মায়ের মৃত্যু, নিজের জমি বেদখল, চরম দারিদ্র্যের মধ্যে প্রথম স্ত্রীর বিদায়, নির্যাতনের কারণে কন্যাসন্তানের মৃত্যু- যেন পৃথিবীতে জন্ম নেয়াটাই ছিল হযরত আলীর পাপ। সর্বশেষ আশ্রয়ও রক্ষা পেল না দুর্ভাগ্যের হাত থেকে। আজীবন বিচারের বাণী শুধু নীরব থেকেছে তার প্রতি। সবকিছু থেকে তাই মুক্তি নিলেন শিশুসন্তানসহ আত্মহননের মধ্য দিয়ে।
গত ২৯ এপ্রিল গাজীপুরের শ্রীপুর রেলস্টেশনের কাছে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে মেয়েসহ আত্মহত্যা করেন হযরত আলী। এরপর গণমাধ্যমে বিষয়টি উঠে এলে টনক নড়ে প্রশাসনের। এখন পরপারে বসে যদি বিচার দেখতে পান এপারের ‘দুর্ভাগা’ হযরত আলী।