চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া, চকরিয়া ও রামু অংশে প্রলেপ (ওভার লে) দিচ্ছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। ২৬ কিলোমিটার এলাকায় প্রলেপের জন্য ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ স্থানীয় লোকজন বলছে, মসৃণ এই মহাসড়কে প্রলেপের প্রয়োজন ছিল না।
আবার নিয়মানুযায়ী প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে না। এ কারণে স্থানীয়রা মনে করছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদার দুর্নীতি করছে।
চকরিয়া সওজ সূত্র জানায়, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা থেকে উত্তর হারবাংয়ের জাইল্যারঢালা পর্যন্ত ১৫ দশমিক পাঁচ কিলোমিটার, সদর ও রামু উপজেলার চার কিলোমিটার, দোহাজারী সড়ক বিভাগের অধীনে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার সাত কিলোমিটার সড়কে এ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন চলছে। গত বছরের ডিসেম্বরে মেসার্স রানা বিল্ডার্স প্রাইভেট লিমিটেড ও হাসান বিল্ডার্স প্রাইভেট লিমিটেডকে কাজ বাস্তবায়নের আদেশ দেওয়া হয়। চলতি বছরের মে মাসে এই কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা।
দরপত্রে বর্ণিত তথ্য মতে, প্রথমে সড়কের উপরিভাগে বিটুমিনের লেপন দিতে হবে। এরপর চার ধরনের ভারতীয় পাকুয়া পাথর ও বিটুমিন মিশিয়ে ৭০ মিলিমিটার পুরুত্বে ঢালাই দেওয়ার কথা। কিন্তু এ নিয়ম কোনো অংশে মানা হচ্ছে না। প্রথমে ২০ মিলিমিটার পাথর, তৎসঙ্গে ১২-১৪ মিলিমিটার ও ৫-১০ মিলিমিটার পাথরের সঙ্গে সিলেট সেন্ট (বালি) অথবা স্টোন ডাস্ট (পাথর গুঁড়া) মিশিয়ে প্রতি বর্গফুটে চার কেজি ওজনের ঢালাই দেওয়ার নিয়ম। বাস্তবে এই নিয়ম মানা হয়নি। গত বৃহস্পতিবার মহাসড়কে চকরিয়ার বরইতলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় কোনো খানাখন্দ নেই। প্রলেপের কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ ঝকঝকে রাস্তার ওপর শ্রমিকরা প্রলেপ দিচ্ছে। আর পাথর ও বিটুমিনের যে ঢালাই দেওয়া হচ্ছে, তা ৩৫ মিলিমিটারের বেশি হবে না। পাথর ও বালির যে ঢালাই দেওয়া হচ্ছে, তা প্রতি বর্গফুটে দুই কেজির বেশি হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সড়ক বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামের দোহাজারী ও কক্সবাজার সড়ক বিভাগের অধীন মহাসড়কের বেশ কিছু অংশে খানাখন্দ হয়েছে। সেখানে কাজ না করে শুধু লুটপাট করার উদ্দেশ্যে একেবারে মসৃণ সড়কের অংশে প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে। সওজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা লুট করা হচ্ছে।
স্থানীয় লোকজনের দাবি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়াসহ যেসব অংশে প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে ওই সব স্থানে এ ধরনের কাজ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কেননা সড়কের এই অংশে প্রলেপ দেওয়ার মতো অবস্থা এখনো সৃষ্টি হয়নি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে প্রলেপ দেওয়া হয়েছে, যা এখনো ঝকঝকে রয়েছে। তা ছাড়া সড়কের অন্য অংশে যেভাবে খানাখন্দ রয়েছে, সেখানে সড়কের কোনো উন্নয়ন করা হচ্ছে না। শুধু লুটপাটের জন্য সরকারি টাকা এভাবে নষ্ট হচ্ছে।
সম্প্রতি সড়ক নেটওয়ার্ক নিয়ে চকরিয়া উপজেলা পরিষদ হলরুমে একটি মতবিনিময় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে একাধিক ব্যক্তি একেবারে মসৃণ মহাসড়কে প্রলেপের নামে দুর্নীতির বিষয়টি উত্থাপন করেন। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মহাপরিচালক সুফিয়া আতিয়া যাকারিয়া। উপস্থিত ছিলেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় বড়ুয়াসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধতন কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে রানা বিল্ডার্সের প্রতিনিধি ফুয়াদ বিন হাবিব অনি বলেন, ‘দরপত্রের শর্ত মোতাবেক যথাযথভাবে কাজ করা হচ্ছে। এখানে কোনো অনিয়ম করা হচ্ছে না। ’ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সহায়ক সংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চকরিয়া উপজেলা সভাপতি অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘এমন প্রকল্প হাতে নিতে হবে, যাতে জনগণের কল্যাণে আসে। যদি শুধু লুটপাট করতে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, তাহলে সরকারি অর্থের অপচয় হতেই থাকবে। এ জন্য কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে নিশ্চিত করতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। ’
সওজ কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় বড়ুয়া বলেন, ‘এটি কোনো লুটপাটের প্রকল্প নয়। ঠিকাদার যাতে যথাযথভাবে কাজ সম্পন্ন করেন, সে জন্য আমরা তত্পর রয়েছি। এত দিন ধরে একটানা কাজ অব্যাহত থাকলেও গত কিছুদিন লাগাতার ভারি বর্ষণের কারণে আপাতত কাজ স্থগিত রাখা হয়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘সড়কের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে একটি প্রো-ফরমা (আর্থিক-বিবরণী) তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে সরেজমিনে গিয়ে দেখার পর এই কাজের বিপরীতে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর কার্যাদেশ দিলে ঠিকাদার কাজ শুরু করেন। ’