‘ঘুষ ছাড়া কি চাকরি হয় বাংলাদেশে’? ‘ঘুষ ছাড়াও হাজার হাজার মানুষের চাকরি হচ্ছে বাংলাদেশে’। আসলে কোন কথাটা সত্য? কিংবা কোন কথাটা বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র বাস্তবতায় তুলনামূলক প্রকট সত্যকে তুলে ধরে? যে ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছে, সে ভাবে, বাকি সবাই ঘুষ দিয়েই চাকরি পেয়েছে। আর যারা ঘুষ ছাড়া মেধা ও পরিশ্রমের জোরে চাকরি পেয়েছে, তারা হাফ ছেড়ে বাঁচেন এই ভেবে যে, ভাগ্যিস ঘুষ লাগে নাই! না হলে এত টাকা কোত্থেকে ম্যানেজ হতো!! অনেকে আবার নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ঘুষের টাকা ম্যানেজ করতে কিংবা টাকা নিয়ে প্রপার চ্যানেলের খোঁজে ব্যস্ত।
সমাজের অবস্থা আসলেও খুব ভালো নয়। আগে বাবা-মা ঘরে কিংবা অফিসে বসে থাকত, ছেলে-মেয়েরা স্কুলের রেজাল্ট পেয়ে দৌড়ে বাসায় এসে বাবা/মা দাদা-দাদিকে সালাম করে দোয়া নিত। মিষ্টি কিনতে দোকানে ভিড় লাগত অভিভাবকদের। আর এখন অনেক পরিবারে দেখা যায়-বাবা, অনেক ক্ষেত্রে মায়েরাও সারাদিন/সারারাত বাইরে থেকে প্রশ্ন ফাঁস করার চেষ্টা করেন। প্রশ্ন নিয়ে বাসায় ফিরেন হয়ত ভোররাতে। নির্ঘুম রাত কাটে ইতোমধ্যেই দুর্নীতি-প্রিয় হয়ে উঠা সন্তানের। বাবা-মায়েরাই এখন দুই নম্বর হয়ে গেছেন। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন কিনতে যে টাকা লাগে তাতো আমাদের ছেলে-মেয়েরা দেয় না। দেয় আমার/আপনার মতো গার্ডিয়ানরাই।
দুর্নীতি নাই বলে যারা গলা ফাটান তারা যেমন ঠিক না। আবার শতভাগই দুর্নীতি বলে যারা দাবি করেন তারাও ঠিক বলেন না। দুর্নীতি আছে যেমন সত্যি তেমন দুর্নীতি নাই এটাও সত্য। নির্ভর করে ক্ষেত্র এবং ব্যক্তির উপর।
শুধু নগদ টাকার ঘুষ নয়, আরও অনেক অনুঘটক নাকি চাকরি পেতে লাগে! গত আট বছরে একটা ধারণা মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে যে, ছাত্রলীগ না করলে কিংবা আওয়ামী লীগ না করলে নাকি চাকরি পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে আসলে এ ধারণা কতটুকু সত্য? ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখেছি, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বড় বড় নেতা, যারা মেধার জোরে বিসিএসের ভাইভা পর্যন্ত একাধিকবার গিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকরি হয়নি তাদের। কেউ প্রমাণ চাইলে অনেককে আমি হাজির করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস আছে।
আবার এমন অনেকের বিসিএস হয়েছে যাদের বিষয়ে ফেসবুকে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে যে এরা একসময় শিবির করতেন। তাদের চাকরি কীভাবে হলো? কেউ কেউ বলেন, কে শিবির করল আর কে ছাত্রলীগ করল সেটা দেখার বিষয় নয়। পরীক্ষায় যে ভালো করবে তারই চাকরি হবে। যদি তাই হয়, তাহলে অনেকের প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে টেলিভিশনের পর্দা, ক্লাসরুমে, মাঠ-ময়দান গরম করে রাখার কিইবা মানে আছে। আবার ‘ছাত্রলীগ; ‘শিবির’ ইত্যাদি প্রত্যয়ের মধ্যে কত অলিগলি বা রাজনীতি আছে সেটা ভাবলেও অবাক হতে হয়। স্বার্থের এবং ক্ষমতার মোহে বা মারপ্যাঁচে ছাত্রলীগ হয়ে যায় শিবির আবার শিবির হয়ে যায় ছাত্রলীগ। কাউকে ঘায়েল করা দরকার বা ক্ষতি করা দরকার, দুই-চার-পাঁচজন মিলে কয়েকদিন প্রচার করে যে টার্গেটকৃত ছেলে বা মেয়ে শিবির করে বা করত। আর যদি হয় সে বেচারা মুসলিম কিংবা মাদ্রাসার ছাত্র, তাহলে তো খুব সহজে করা যায় এই অপকর্ম। কথা শুনল না বা অন্যায় কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল, তাহলেই সে ছেলে/মেয়েকে বানিয়ে দেয়া হয় শিবির। খুব কঠিন রাজনীতি এটা। যে আসলেই শিবির করে বা করত সে কিন্তু চাকরি পেয়ে ভালো পোস্টিং নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছে। তাকে গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং দিয়ে রেখেছে সরকার নিজেই। তাকে কেউ সরাতেও পারছে না। তার হাত অনেক লম্বা। এ এক বিরল আজব খেলা। সম্ভবত পৃথিবীর আরও কোন দেশে এমন গেম হয় না। এ গেম যারা খেলে তারা খুব ঠান্ডা মস্তিষ্কের হয়। যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের জন্য কিছু করতে চায় তাদেরকেই বানিয়ে দেয়া হচ্ছে শিবির। সততা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই এই অপকৌশলের শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছে এভাবে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়ত স্বাধীনতা-বিরোধীরাই সমাজ এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেবে।
আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের কপালে এমন কিছু কোনোদিন হবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। কারণ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জামায়াতে ইসলামী এবং শিবিরের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে সক্ষম হয়েছে মর্মে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে অনেকবার। এরা যে ধীরে ধীরে একদিন আওয়ামী লীগ এর মাথা খাবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছর পরে এসে এখন তরুণ সমাজের মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়- বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কার জোর বেশি? টাকার না মেধার? পরিশ্রমের না ঘুষের? প্রশ্নগুলো খুবই স্পর্শকাতর এবং অনুচিত। কিন্তু একটা অসুখ ভালো করতে গিলে তার ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। তাই আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে এগুতে হবে। ‘দেশে দুর্নীতি নাই’ কিংবা ‘সবাই ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়’ এমন ঢালাও কথা যারা বলে তারা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়ে সমাজের একই ক্ষতি করে।
পূর্ণ সত্য বা পূর্ণ মিথ্যা বলে কিছু আছে কি? নাকি সবই অর্ধসত্য কিংবা অর্ধমিথ্যা? ইদানীং একটা কথা ফেসবুকে দুই একজন লিখছেন। হালাল খাবার নিয়ে আমাদের যত টেনশন, হালাল ইনকাম নিয়ে আমাদের সেরকম টেনশন নাই। সৃষ্টিকর্তার সাথেও আমরা চালাকি করছি। ঘুষটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখেই নামাজের জন্য দৌড়, আবার নামাজ শেষ করে এসেই আবার ঘুষের লেনদেন। এমন বাস্তবতা দেশের প্রায় সব দপ্তরে আছে বলে আমাদের কাছে লোকজন বলে। কিন্তু স্বীকার করে না সরকার। স্বীকার না করলেও মানুষ জানে এদেশে ঘুষ দিতে হয় নানা কাজে। বিশ্ববাসীও জানে। বিশ্বের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আমরা দুর্নীতিতে এক থেকে পাঁচ/ছয় নম্বর স্থান অর্জন করে চলেছি! এমনকি কিছু কিছু ক্যাডার সার্ভিস আছে যেখানে মাস শেষে অফিসারদের বেতনের চেক প্রক্রিয়াজাত করতেও নিম্নপদস্থদের ঘুষ দিতে হয় বলে শুনেছি। বিশেষ করে ডাক্তারদের অবস্থা খুব খারাপ। ঢাকার যেকোনো একটা সরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিলেই আমার শোনা কথার সত্যতা পেতে পারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো চাকরি বাজারে প্রবেশের জন্য যারা প্রস্তুতি নিচ্ছে অর্থাৎ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা তাদের মনের অবস্থা কী? ক্লাসে এরা নীতিকথা শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু নিজেদের মধ্যে, পরিবারে কিংবা সমাজে এরা কী শুনে বা বলে? কোনো কোনো চাকরি প্রার্থীর অভিজ্ঞতাকে যদি কেউ পুরো সিস্টেম এর প্রতিভূ বলে ধরে নেয়, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের সামনে সমূহ বিপদ।
ব্যক্তি হিসেবে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলাদেশে হাতে গোনা গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশের আসনে বসে গণভবনে তাকে ইফতার করতে দেখা যায় রোজার মাসে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলদেশ গড়ার মিশনে বাম নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব কাছের একজন মানুষ তিনি। সব দল-মতের মানুষই তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ আদান-প্রদান নিয়ে তিনি এক মন্তব্য করে মহল গরম করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঘুষ ছাড়া সরকারি চাকরি পেয়েছেন এমন কেউ থাকলে তিনি নাকি সংবর্ধনা দেবেন। এর মানে হলো, দেশের ছেলে-মেয়েরা যত সরকারি চাকরি পাচ্ছে, সবাই ঘুষ নিয়ে চাকরি নিচ্ছেন? ফেসবুক থাকাতে তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে জোরেশোরে। শত শত মানুষ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলছেন-‘আমি ঘুষ ছাড়াই চাকরি পেয়েছি, আমাকে সংবর্ধনা দিন’।
একজন জাতীয় নেতা অতি সরলীকরণ করে একটা মন্তব্য করেছেন বলে লোকজন ফেসবুকে সমালোচনা করছেন। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এর মত বড় ব্যক্তিত্ব যখন এমন ঢালাও মন্তব্য করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সচেতন সৎ মহল একটু সরব হয়েছেন। তারা বলছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যখন কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, তখন সবাই ঘুষ নিয়ে চাকরি নিচ্ছে এমন মন্তব্য সমাজের জন্য অত্যন্ত হানিকর। সব চাকরিই যদি ঘুষের বিনিময়ে হয় তাহলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কী দরকার? শিক্ষকরা এত পরিশ্রম করছেন, ছাত্র-ছাত্রীরা অধিকাংশই মনপ্রাণ দিয়ে পড়াশুনা করছে। অধিকাংশ অভিভাবক এখনো সততা ধরে রেখেই ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা করাচ্ছেন। দুর্নীতি আছে সত্যি, কিন্তু সবাই দুর্নীতিবাজ না। একজন পুলিশ কনস্টেবল এর কথা জেনেছিলাম, যিনি রাস্তায় এক ব্যক্তির ডলার, পাসপোর্টসহ একটি প্যাকেট পেয়ে এর মালিককে খুঁজে বের করে দিয়ে এসেছেন।
যারা ঘুষ না দিয়েই চাকরি পেয়েছে তাদের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কথা ভালো লাগেনি। হ্যাঁ তদবির লাগে অনেক সময়। আবার তদবির ছাড়াও শত শত তরুণ-তরুণীর চাকরি হচ্ছে। আবার এটাও ঠিক অনেকে আগে থেকেই সিস্টেমের উপর ভরসা হারিয়ে প্রাইভেট জব বেছে নিচ্ছেন। আবার অনেকে আছেন, অন্য সবাইকে সন্দেহ করেন। নিজের চাকরিটা হয়নি বলে অন্যকে সন্দেহ করেন। রেজাল্ট ভালো না হলে মনে করেন, অন্যরা হয়ত প্রশ্ন পেয়ে ভালো করে ফেলেছে। সব মিলে একটা অবিশ্বাস আর সন্দেহের আবহে আমরা ধীরে ধীরে বন্দী হয়ে যাচ্ছি। এ থেকে মুক্ত হতে হলে, সমস্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের জিহাদ করতে হবে। কিন্তু এ জিহাদ ব্যর্থ হবে, যদি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মত বড় মানুষেরা এমন ঢালাও মন্তব্য করে আমাদের তরুণ-তরুণীদের ডিমোরালাইজ করেন। একটা সৎ প্রজন্ম আমাদের তৈরি করতে হবে। এমন প্রজন্ম তৈরি করতে হলে শক্ত মন-মানসিকতার ছেলে-মেয়ে তৈরি করতে হবে আমাদের।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়